পিরিয়ড অনিয়মিত কেন হয়, লক্ষণ ও চিকিৎসা
বর্তমান দিনে শতকরা নব্বই ভাগ নারীরাই অনিয়মিত পিরিয়ড বা ঋতুস্রাবের সমস্যায় ভুগছেন। নারীদের এই অনিয়মিত পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব জটিল সমস্যার কারণ হতে পারে। এই সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাহানারা চৌধুরী।
অনিয়মিত পিরিয়ড কী
ডা. সাহানারা চৌধুরী বলেন, নারীর পিরিয়ডের একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। ২৩ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে একটা পিরিয়ড হয় অর্থাৎ এই সময়কালে একটা পিরিয়ড থেকে আরেকটা পিরিয়ড ফেরত আসে। পিরিয়ড সাধারণত ২৮ দিন পরপর হয়।
পিরিয়ড শুরু হওয়ার পর ৩ থেকে ৭ দিন থাকবে। প্রথম দিন ব্লিডিং একটু কম হবে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন বেশি হবে, আবার এরপর থেকে কমবে। পিরিয়ডের সময় সর্বোচ্চ ৮০ মিলিলিটার রক্ত যাবে এবং কখনোই সেটি চাকা বাঁধা রক্ত হবে না। এটা হচ্ছে পিরিয়ডের স্বাভাবিক চক্র।
যখনই এই স্বাভাবিক ঋতুচক্রের তারতম্য হয় তখনই তাকে অনিয়মিত পিরিয়ড বলে। যেমন-
১. সময়ের আগে কিংবা দেরিতে পিরিয়ড হওয়া। ২৩ দিনের আগে পিরিয়ড হলে, মাসে ২ থেকে ৩ বার পিরিয়ড হলে, আবার ৩৫ দিনের পরে দেড়-দুই মাস কিংবা তারও বেশি দিন পর পিরিয়ড হলে সেটি অনিয়মিত পিরিয়ড।
২. দুই পিরিয়ডের মাঝখানে একটু একটু ব্লিডিং হওয়া অনিয়মিত পিরিয়ড। সাধারণত ২৮ দিন পরপর পিরিয়ড হয়। কিন্তু যদি দেখা যায় ১২ দিন, ১৬ দিন কিংবা ২০ দিন পর অর্থাৎ সারা মাসেই একটু ব্লিডিং হচ্ছে সেটি অনিয়মিত পিরিয়ড।
৩. পিরিয়ড যদি ৫ থেকে ৭ দিনের বেশি স্থায়ী হয়, ১০ থেকে ১৫ দিন একটানা পিরিয়ড থাকে তবে তা অনিয়মিত।
৪. পিরিয়ড ৫ থেকে ৭ দিন থাকছে কিন্তু অতিরিক্ত ব্লিডিং, ব্যথা হওয়া এবং চাকা চাকা রক্ত যাওয়াকেও অনিয়মিত পিরিয়ড বলে।
কেন হয়
ডা. সাহানারা চৌধুরী বলেন, নারীর পিরিয়ড নিয়ন্ত্রণ করে হাইপোথ্যালামো পিটুইটারি ওভারিয়ান অ্যাক্সিস। হাইপোথ্যালামাস মানে মস্তিষ্ক, পিটুইটারি হলো মস্তিষ্কের একটি গ্রন্থি এবং ওভারি হচ্ছে ডিম্বাশয়। এই তিনটির সমন্বিত প্রভাবে হরমোন তৈরি হয় এবং জরায়ুর উপর কাজ করে পিরিয়ডকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই অ্যাক্সিসে যখন কোনো তারতম্য হয় তখন অনিয়মিত পিরিয়ড হয়। যেমন-
কিশোরী বয়সে
১. কিশোরী বয়সে পিরিয়ড শুরু হয়। তাদের মস্তিষ্কের ম্যাচিয়ুরিটি না আসার কারণে ওভারির উপর হরমোনাল প্রভাব অনিয়মিত হয়। যে কারণে ১৮ বছর পর্যন্ত অনিয়মিত পিরিয়ড হতে পারে।
আবার নারীর মেনোপজ ৪৮ থেকে ৫২ বছর বয়সে হয়। পিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়ার ওই সময়টাতেও মস্তিষ্ক ইম্যাচিয়্যুর হিসেবে কাজ করবে। প্রথম পিরিয়ড শুরু হওয়ার পরে এবং একেবারে শেষ হওয়ার আগে হরমোনাল তারতম্যের কারণে পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে কোনো ধরনের রোগ ছাড়াই। এ ছাড়া নারীর ১৮ থেকে ৪৫ বছর অর্থাৎ প্রজনন বয়সে অনেকগুলো কারণে অনিয়মিত পিরিয়ড হয়।
২. অল্প বয়সে হিমফিলিয়াসহ কিছু রক্তরোগের কারণে অনিয়মিত পিরিয়ড হতে পারে।
৩. পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমের কারণে অনিয়মিত পিরিয়ড হয়।
৪. জরায়ুতে কোনো অসুখ থাকলে হতে পারে।
প্রজনন বয়সে
গর্ভধারণ এবং গর্ভধারণজনিত কারণে অনিয়মিত পিরিয়ড হতে পারে।
১. গর্ভপাত হলে পিরিয়ড অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে।
২. সন্তান জন্মদানের পর কিছুদিন অনিয়মিত পিরিয়ড হতে পারে।
৩. সন্তানকে স্তন্যদানের সময় ফিজিওলজিক্যাল কারণেই অনিয়মিত পিরিয়ড হতে পারে।
PALM-COEIN এর কারণে
ডা. সাহানারা চৌধুরী বলেন, অনিয়মিত পিরিয়ডের অন্যতম কারণ PALM-COEIN, এর প্রতিটি শব্দ এক একটি রোগকে বহন করে।
১. পলিপ- জরায়ুর ভেতর পলিপ থাকলে অনিয়মিত পিরিয়ড হতে পারে।
২. অ্যাডিনোমায়োসিস- এটি জরায়ুর টিউমার, যেটাতে জরায়ু অনেক বড় হয়ে যায়।
৩. লিওমায়োমা- লিওমায়োমা যা ফ্রাইবয়েড নামেও পরিচিত, এক ধরনের টিউমার।
৪. ম্যালিগন্যান্সি- জরায়ু ও জরায়ু মুখে যদি কোনো ম্যালিগন্যান্সি থাকে।
পলিপ, টিউমার, ফাইব্রয়েড ও ক্যানসার এই চারটি জরায়ুর আকৃতিগত ত্রুটি, যার কারণে পিরিয়ডের তারতম্য হতে পারে।
৫. কোয়াগুলেশন ডিজঅর্ডার- রক্ত জমাট বাঁধার রোগ থাকলে।
৬. ওভুলেটরি ডিজঅর্ডার- প্রতি মাসে ওভারিতে ডিম তৈরি হয়, এখানে যদি কোন তারতম্য হয়। এই তারতম্য বেশি হয় বিশেষ করে যারা পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমে ভোগেন তাদের। পিসিওএস রোগীদের ওভুলেশন না হওয়ার কারণে অনিয়মিত পিরিয়ড বেশি হয়। তারা মোটা হয়ে যান এবং তাদের সন্তান ধারণে সমস্যা হয়।
৭. আয়াট্রোজেনিক- ওষুধজজনিত কারণে অনিয়মিত পিরিয়ড। চিকিৎসকদের দেওয়া ওষুধ নিয়ম মেনে না খাওয়া বা খাওয়া বন্ধ করে দেওয়ার কারণে হতে পারে। পিরিয়ড সমস্যার জন্য, ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিসসহ রক্ত জমাট না বাঁধার জন্য দেওয়া বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে।
৮. অ্যান্ড্রোমেট্রিয়াম- অ্যান্ড্রোমেট্রিয়াল পলিপ, অ্যান্ড্রোমেট্রিয়াল ক্যান্সার, অ্যান্ড্রোমেট্রিয়ামে যদি কোনো রোগ থাকে।
৯. উপরের বিষয়গুলো ছাড়াও জানা যায়নি এমন কিছু কারণে অনিয়মিত পিরিয়ড হতে পারে।
ঝুঁকি
ডা. সাহানারা চৌধুরী বলেন, অনিয়মিত পিরিয়ডে সাধারণ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে, অ্যানিমিয়ার কারণে দুর্বলতা ও শ্বাসকষ্ট হতে পারে, দীর্ঘদিন স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের কারণে ঘা হতে পারে, স্বাভাবিক জীবনাচরণ ব্যাহত হয়, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে।
যদি কোনো রোগের কারণে অনিয়মিত পিরিয়ড হয়, সেটি মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বেশিদিন পলিপ থেকে ব্লিডিংয়ের পাশাপাশি পলিপ ক্যানসার হতে পারে। টিউমার থাকলে সন্তান ধারণ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। ম্যালিগনেন্সি ক্যানসার হতে পারে। দীর্ঘদিন যদি কারো অনিয়মিত পিরিয়ড হয় আর সেটি যদি পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমের জন্য হয়, তাদের ভবিষ্যতে অ্যান্ডোমেট্রিয়াল ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি থাকে। পিসিওএস থাকলে সন্তান হতে চায় না, অনেকের হাত,পা, মুখে অবাঞ্ছিত লোম হয়, ওজন বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে মানসিক অশান্তি দেখা দেয়।
চিকিৎসা
ডা. সাহানারা চৌধুরী বলেন, অনিয়মিত পিরিয়ডে রক্তশূন্যতা দূর করার জন্য হিমোগ্লোবিন লেভেল দেখে মুখে খাওয়ার আয়রন ট্যাবলেট, আয়রন ইনজেকশন, প্রয়োজনে শরীরে রক্ত দিতে হয়।
ব্লিডিং বন্ধ করার জন্য উচ্চ মাত্রার প্রোজেস্টেরন হরমোন এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া ট্র্যাক্সিল বা ট্র্যানক্সামিক অ্যাসিড ব্যবহার করা হয়।
এরপর যে রোগের কারণে অনিয়মিত পিরিয়ড হচ্ছে তা শনাক্ত করে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে। যেমন- পলিপ বা টিউমার হলে সেগুলো রিমুভ করতে হবে, কোয়াগুলেশন, ওভুলেটরি ডিজঅর্ডার, পিসিওএস থাকলে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা এবং ক্যানসরি হয়েছে কি না সেটি শনাক্ত করে চিকিৎসা নির্ধারণ করতে হবে।
অনিয়মিত পিরিয়ড অনেকগুলো রোগের লক্ষণ। তাই পিরিয়ডের সমস্যায় অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ওষুধ নিয়ম মেনে খেতে হবে। জীবনধারা ও খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আনতে হবে। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে, জাঙ্ক ফুড পরিহার করতে হবে, সুষম খাবার, ফল-শাকসবজি খেতে হবে।