
চোখের ভাষা!

রেজুয়ান আহম্মেদ
সন্ধ্যার আলোয় প্রথম দেখা...
সন্ধ্যার শেষ আলোটি যখন পশ্চিমাকাশে মিলিয়ে যাচ্ছিল, আরশি তার বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। তার হাতে ছিল একটি পুরনো ডায়েরি, যার পাতাগুলো সময়ের সাথে হলদেটে হয়ে গেছে। বাতাসে তার লম্বা চুল উড়ছিল, আর সে চোখ বুজে গভীর নিশ্বাস নিল। আজ তার মন কেন জানি অস্থির হয়ে উঠেছিল। কিছু একটা মনে পড়ছিল, কিন্তু ঠিক ধরতে পারছিল না।
আরশির বাড়িটি ছিল সিলেট শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে, একটি ছোট পাহাড়ের কোলে। এখানে সন্ধ্যা নামলে চারপাশ যেন কবিতার মতো হয়ে উঠত। আকাশে রঙের খেলা, দূরে পাখির ডাক, আর বাতাসে বুনো ফুলের গন্ধ—সব মিলিয়ে এ সময়টাকে আরশি ভীষণ ভালোবাসত। এই মুহূর্তে তার মন যেন অচেনা কোনো সুরে বেজে উঠত।
আজ সে ডায়েরিটি খুলে বসল। প্রথম পাতায় লেখা ছিল—
“তোমার চোখে প্রেম দেখি,
তোমার চোখে চেয়ে দেখি সন্ধ্যার শেষ আলো...”
লাইনগুলো পড়তেই তার মন যেন দোল খেলে উঠল। এই কবিতাটি তার লেখা নয়, তবুও এটি তার মনের গভীরে জায়গা করে নিয়েছিল। এটা লিখেছিল রাহাত। রাহাত, যার হাসিতে আরশির বুকের ভেতর গান বাজত। রাহাত, যার চোখে আরশি এক অদ্ভুত ভালোবাসার ঢেউ দেখত।
ভালোবাসার রঙিন রেশ...
এরপর থেকে আরশি আর রাহাতের দেখা হত প্রায়ই। কখনো বইমেলায়, কখনো নদীর ধারে, কখনো কোনো ক্যাফেতে। রাহাতের কথায় এমন মাদকতা ছিল যে আরশির ক্লান্তি গলে যেত। তার হাসি, ছোঁয়া, চোখের ভাষা—সবকিছুই আরশির মনে বসন্ত নামিয়ে আনত।
একদিন বৃষ্টির মধ্যে তারা দুজন একটি পুরনো গাছের নিচে দাঁড়িয়েছিল। রাহাত বলল, “জানো আরশি, তোমার চোখে আমি সন্ধ্যার শেষ আলো দেখি। যেন সব শান্ত, তবু গভীর।”
আরশি হেসে জবাব দিল, “তুমি কেন সবসময় কবিতার মতো কথা বলো?”
রাহাতের চোখে দৃঢ়তা ঝলসে উঠল, “কারণ তুমি নিজেই এক জীবন্ত কবিতা।”
সেই মুহূর্তে আরশি অনুভব করল, তার হৃদয়ের গভীরে রাহাতের জন্য ভালোবাসার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল। রাহাতের পাশে থাকলে সময় যেন স্থির হয়ে যেত। তার প্রতিটি কথা, হাসি, আর ছোঁয়ায় আরশির মনে হতো—সমগ্র দুনিয়া শুধু রাহাত।
বিচ্ছেদের ছায়া...
কিন্তু জীবন সবসময় স্বপ্নের মতো চলে না। দুই বছর পর একটি দুর্ঘটনা সবকিছু বদলে দিল। রাহাত একটি বাইক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করল। খবরটা পেয়ে আরশির পৃথিবী যেন থমকে গেল। সে বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে রাহাত আর নেই। যে চোখে সে ভালোবাসার ঢেউ দেখত, সেই চোখ এখন চিরতরে বন্ধ।
রাহাতের মৃত্যুর পর আরশির জীবন থেকে যেন সব রঙ উবে গেল। সে আর আগের মতো হাসত না, কথা বলত না। তার মন যেন ফাঁকা মাঠ, যেখানে শুধু রাহাতের স্মৃতি ঘুরে বেড়াত। রাহাতের লেখা কবিতার পাতা সে বুকে চেপে রাখত। প্রতিটি লাইন পড়ে তার চোখ অশ্রুতে ভিজে যেত।
ভালোবাসার পুনর্জন্ম...
একদিন আরশি ঠিক করল—রাহাতের স্বপ্ন সে পূরণ করবে। রাহাত চেয়েছিল তার কবিতা মানুষের কাছে পৌঁছাক। আরশি ডায়েরি থেকে রাহাতের সব কবিতা সংগ্রহ করল। একটি ছোট প্রকাশনা সংস্থার সাথে যোগাযোগ করতেই তারা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। প্রকাশক বললেন, “এই কবিতাগুলো মানুষের হৃদয় স্পর্শ করবে।”
বইটি ছাপার কাজ শুরু হলো। আরশি নিজেই প্রতিটি পাতা সম্পাদনা করল। বইয়ের প্রথম পাতায় সে লিখল—
“রাহাতের কবিতা, আরশির ভালোবাসা।”
বইটি প্রকাশের পরই মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। পাঠকরা চিঠি লিখতে শুরু করলেন। একজন লিখলেন, “এই কবিতাগুলো পড়ে মনে হলো, ভালোবাসা কখনো মরে না। এটি চিরজীবী এক গল্প।”
আরশি চিঠিটি পড়ে হাসল। সে জানত, রাহাতের ভালোবাসা তার মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবে।
নতুন শুরু...
সময়ের সাথে আরশি আবার হাসতে শিখল। রাহাতের কবিতার সাফল্য তাকে নতুন জীবন দিল। সে একটি ছোট লাইব্রেরি খুলল, যেখানে তরুণ কবিরা তাদের লেখা শেয়ার করতে আসে। আরশি তাদের সাথে রাহাতের গল্প বলত, “ভালোবাসা কখনো থামে না। এটি বেঁচে থাকে কবিতায়, স্মৃতিতে, মানুষের হৃদয়ে।”
এক সন্ধ্যায় লাইব্রেরির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আরশি আকাশের দিকে তাকাল। সন্ধ্যার শেষ আলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছিল। সে মুচকি হেসে মনে মনে বলল, “রাহাত, তুমিই আমার আকাশ, তুমিই আমার আলো...”