img

চোখের ভাষা!

প্রকাশিত :  ১৯:৩৬, ০৫ মে ২০২৫

চোখের ভাষা!

রেজুয়ান আহম্মেদ

সন্ধ্যার আলোয় প্রথম দেখা...  

সন্ধ্যার শেষ আলোটি যখন পশ্চিমাকাশে মিলিয়ে যাচ্ছিল, আরশি তার বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। তার হাতে ছিল একটি পুরনো ডায়েরি, যার পাতাগুলো সময়ের সাথে হলদেটে হয়ে গেছে। বাতাসে তার লম্বা চুল উড়ছিল, আর সে চোখ বুজে গভীর নিশ্বাস নিল। আজ তার মন কেন জানি অস্থির হয়ে উঠেছিল। কিছু একটা মনে পড়ছিল, কিন্তু ঠিক ধরতে পারছিল না।  

আরশির বাড়িটি ছিল সিলেট শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে, একটি ছোট পাহাড়ের কোলে। এখানে সন্ধ্যা নামলে চারপাশ যেন কবিতার মতো হয়ে উঠত। আকাশে রঙের খেলা, দূরে পাখির ডাক, আর বাতাসে বুনো ফুলের গন্ধ—সব মিলিয়ে এ সময়টাকে আরশি ভীষণ ভালোবাসত। এই মুহূর্তে তার মন যেন অচেনা কোনো সুরে বেজে উঠত।  

আজ সে ডায়েরিটি খুলে বসল। প্রথম পাতায় লেখা ছিল—  

“তোমার চোখে প্রেম দেখি,  

তোমার চোখে চেয়ে দেখি সন্ধ্যার শেষ আলো...”  

লাইনগুলো পড়তেই তার মন যেন দোল খেলে উঠল। এই কবিতাটি তার লেখা নয়, তবুও এটি তার মনের গভীরে জায়গা করে নিয়েছিল। এটা লিখেছিল রাহাত। রাহাত, যার হাসিতে আরশির বুকের ভেতর গান বাজত। রাহাত, যার চোখে আরশি এক অদ্ভুত ভালোবাসার ঢেউ দেখত।  

ভালোবাসার রঙিন রেশ...  

এরপর থেকে আরশি আর রাহাতের দেখা হত প্রায়ই। কখনো বইমেলায়, কখনো নদীর ধারে, কখনো কোনো ক্যাফেতে। রাহাতের কথায় এমন মাদকতা ছিল যে আরশির ক্লান্তি গলে যেত। তার হাসি, ছোঁয়া, চোখের ভাষা—সবকিছুই আরশির মনে বসন্ত নামিয়ে আনত।  

একদিন বৃষ্টির মধ্যে তারা দুজন একটি পুরনো গাছের নিচে দাঁড়িয়েছিল। রাহাত বলল, “জানো আরশি, তোমার চোখে আমি সন্ধ্যার শেষ আলো দেখি। যেন সব শান্ত, তবু গভীর।”  

আরশি হেসে জবাব দিল, “তুমি কেন সবসময় কবিতার মতো কথা বলো?”  

রাহাতের চোখে দৃঢ়তা ঝলসে উঠল, “কারণ তুমি নিজেই এক জীবন্ত কবিতা।”  

সেই মুহূর্তে আরশি অনুভব করল, তার হৃদয়ের গভীরে রাহাতের জন্য ভালোবাসার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল। রাহাতের পাশে থাকলে সময় যেন স্থির হয়ে যেত। তার প্রতিটি কথা, হাসি, আর ছোঁয়ায় আরশির মনে হতো—সমগ্র দুনিয়া শুধু রাহাত।  

বিচ্ছেদের ছায়া...  

কিন্তু জীবন সবসময় স্বপ্নের মতো চলে না। দুই বছর পর একটি দুর্ঘটনা সবকিছু বদলে দিল। রাহাত একটি বাইক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করল। খবরটা পেয়ে আরশির পৃথিবী যেন থমকে গেল। সে বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে রাহাত আর নেই। যে চোখে সে ভালোবাসার ঢেউ দেখত, সেই চোখ এখন চিরতরে বন্ধ।  

রাহাতের মৃত্যুর পর আরশির জীবন থেকে যেন সব রঙ উবে গেল। সে আর আগের মতো হাসত না, কথা বলত না। তার মন যেন ফাঁকা মাঠ, যেখানে শুধু রাহাতের স্মৃতি ঘুরে বেড়াত। রাহাতের লেখা কবিতার পাতা সে বুকে চেপে রাখত। প্রতিটি লাইন পড়ে তার চোখ অশ্রুতে ভিজে যেত।  

ভালোবাসার পুনর্জন্ম...

একদিন আরশি ঠিক করল—রাহাতের স্বপ্ন সে পূরণ করবে। রাহাত চেয়েছিল তার কবিতা মানুষের কাছে পৌঁছাক। আরশি ডায়েরি থেকে রাহাতের সব কবিতা সংগ্রহ করল। একটি ছোট প্রকাশনা সংস্থার সাথে যোগাযোগ করতেই তারা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। প্রকাশক বললেন, “এই কবিতাগুলো মানুষের হৃদয় স্পর্শ করবে।”  

বইটি ছাপার কাজ শুরু হলো। আরশি নিজেই প্রতিটি পাতা সম্পাদনা করল। বইয়ের প্রথম পাতায় সে লিখল—  

“রাহাতের কবিতা, আরশির ভালোবাসা।”  

বইটি প্রকাশের পরই মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। পাঠকরা চিঠি লিখতে শুরু করলেন। একজন লিখলেন, “এই কবিতাগুলো পড়ে মনে হলো, ভালোবাসা কখনো মরে না। এটি চিরজীবী এক গল্প।”  

আরশি চিঠিটি পড়ে হাসল। সে জানত, রাহাতের ভালোবাসা তার মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবে।  

নতুন শুরু...

সময়ের সাথে আরশি আবার হাসতে শিখল। রাহাতের কবিতার সাফল্য তাকে নতুন জীবন দিল। সে একটি ছোট লাইব্রেরি খুলল, যেখানে তরুণ কবিরা তাদের লেখা শেয়ার করতে আসে। আরশি তাদের সাথে রাহাতের গল্প বলত, “ভালোবাসা কখনো থামে না। এটি বেঁচে থাকে কবিতায়, স্মৃতিতে, মানুষের হৃদয়ে।”  

এক সন্ধ্যায় লাইব্রেরির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আরশি আকাশের দিকে তাকাল। সন্ধ্যার শেষ আলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছিল। সে মুচকি হেসে মনে মনে বলল, “রাহাত, তুমিই আমার আকাশ, তুমিই আমার আলো...”

img

ঈদ যখন কাঁদে অভাবের কাছে: উৎসবের আলো আর অন্ধকারের গল্প

প্রকাশিত :  ০৫:৩০, ০৮ জুন ২০২৫

ঈদের নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোট ছোট শিশুর হাসিমাখা মুখ, নতুন জামার রঙ, বাজারের কোলাহল, সুগন্ধে ভরা রান্নাঘর আর পরিবারজুড়ে ভালোবাসার উষ্ণতা। মনে হয়, এ যেন এক মিলনের উৎসব, ভালোবাসার উৎসব—মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোর এক মহা-উপলক্ষ।

কিন্তু একটু ভাবুন—এই উৎসব কি সবার জন্য একই রকম আনন্দ বয়ে আনে?

ঈদের পেছনের সেই নিঃশব্দ কান্না

আমরা অনেকেই ঈদের আগে বাজারে যাই, জামাকাপড় কিনি, খাবারদাবারে ঘর সাজাই, ছবি তুলে পোস্ট দিই—সবই স্বাভাবিক আনন্দের অংশ। কিন্তু আমাদের আশপাশেই এমন অনেক পরিবার আছে, যারা ঈদের আগের রাতে জানে না, পরদিন সকালে তাদের শিশুটি আদৌ কিছু খেতে পাবে কি না।

তারা ফেসবুকে অন্যদের ছবিতে ঈদের রঙ দেখে, ছেলেমেয়েদের হাসিমুখ দেখে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঈদের আমেজটা গায়ে মাখার চেষ্টা করে—কিন্তু মনে মনে ভেঙে পড়ে।

একজন মা যখন সন্তানের নতুন জামার আবদার শুনে চুপ করে থাকেন, চোখের জল আড়াল করতে রান্নাঘরে চলে যান—তখন ঈদের আনন্দ তার কাছে হয়ে ওঠে এক অদৃশ্য বোঝা।

তিনি বলেন, “কাল পাবে বাবা, কাল পাবে”—এই ‘কাল’ যে কবে আসবে, তিনি নিজেও জানেন না। তবু সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করাটাই যেন তার ঈদের একমাত্র প্রস্তুতি।

রিকশাচালক বাবার সন্ধ্যা

রিকশা চালানো মানুষটি ঈদের দিনেও রাস্তায় থাকেন—কারণ এই দিনটিতে একটু বেশি উপার্জনের সম্ভাবনা থাকে। সন্ধ্যায় তিনি বাড়ি ফেরেন ক্লান্ত শরীরে, পকেট ফাঁকা, মুখে নিঃশব্দ বিষণ্ণতা।

বাচ্চা জিজ্ঞাসা করে, “বাবা, আমার জামা কই?”

তিনি মাথা নিচু করে বলেন, “এইবার না, পরেরবার।”

এই কথাটি বলার সময় তার বুকের ভেতর যে ঝড় বয়ে যায়—তা কেউ দেখে না, কেউ বোঝেও না।

শিশুর চোখে ঈদের রংহীনতা

ঈদ তো শিশুদের আনন্দের দিন—এমনটাই শুনে বড় হয় তারা। কিন্তু যেসব শিশু নতুন জামা পায় না, খেলনা পায় না, পেট ভরে খেতে পায় না—তারা কেমন করে ঈদ উদযাপন করে?

তারা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঈদ দেখে। এক ধরনের ঈর্ষা, অপমান আর অক্ষমতা মিশে তৈরি হয় তাদের জীবনের প্রথম ঈদের শিক্ষা—“ঈদ সবার জন্য নয়।”

এই শিক্ষা একটি শিশুকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তাদের হৃদয়ে জন্ম নেয় অভিমান, সমাজব্যবস্থার প্রতি রাগ, ঈদের প্রতি ঘৃণা।

ঈদের আসল পাঠ—কোথায় হারিয়ে গেল?

ঈদের মূল শিক্ষা ছিল সহমর্মিতা, সমতা ও ভালোবাসা। কিন্তু আজকাল এই শিক্ষা অনেক সময় ফেসবুক পোস্ট আর ছবি তোলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। যাকাত-সদকা অনেকটাই লোক দেখানো কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে।

আসলে, একটি দরিদ্র শিশুকে জামা কিনে দেওয়া কোনো দয়া নয়—এটা তার ন্যায্য প্রাপ্য। একজন রিকশাচালককে ঈদের দিনে এক প্যাকেট বিরিয়ানি দেওয়া সহানুভূতি নয়, বরং ন্যূনতম মানবিক দায়িত্ব পালন।

হাজার টাকায় ফিরতে পারে একটি ঈদ

আপনার ঈদের খরচ যদি পঞ্চাশ হাজার টাকা হয়, তার মধ্যে মাত্র এক হাজার টাকা ব্যয় করলেই একটি পরিবারের মুখে ঈদের হাসি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

একটা জামা, একজোড়া জুতো, এক প্লেট বিরিয়ানি—এগুলো কোনো বিলাসিতা নয়। সামান্য সদিচ্ছা থাকলেই এই ছোট ছোট উপহারগুলো বহু মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারে।

ঈদ সবার হোক—তবেই পূর্ণতা

আমরা চাই না সবাই সমাজবিপ্লবী হোক। শুধু চাই—আপনার পাশের দরিদ্র শিশুটির জন্য একটি জামা কিনে দিন। রাস্তার সেই বৃদ্ধ মায়ের হাতে এক প্যাকেট মিষ্টি তুলে দিন।

এই ছোট ছোট ভালোবাসার কাজগুলোই ঈদকে সত্যিকার অর্থে সবার করে তোলে।

রাষ্ট্র কি পারত না পাশে দাঁড়াতে?

একটি রাষ্ট্র চাইলে ঈদের দিনে কোনো পরিবার না খেয়ে থাকবে না—এটা নিশ্চিত করা কঠিন কিছু নয়। ঈদের সময় একটি কেন্দ্রীয় কর্মসূচি চালু করে দরিদ্র পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়া যেত—এটা হতে পারত এক নতুন দৃষ্টান্ত।

সরকারি খাদ্য সহায়তা, জামা বিতরণ, শিশুবান্ধব উপহার কার্যক্রম—এসব শুরু হলে ঈদ আর কারো জন্য অন্ধকার হয়ে থাকত না।

ঈদ হোক ভালোবাসার নাম

আমরা যতই বলি ঈদ মানে আনন্দ, ততদিন তা খালি বুলি হিসেবেই থাকবে—যতদিন না আমরা সেই আনন্দ সবার মাঝে ভাগ করে নিতে শিখি।

এই ঈদে আসুন আমরা কিছু সিদ্ধান্ত নিই—একটি মুখে হাসি ফোটাব, একটি পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে বলব: “তোমরা একা নও।”

এই ছোট ছোট ভালোবাসার স্পর্শগুলোই ঈদকে ঈদ বানায়। নামাজ শেষে কোলাকুলি করার আগে যদি একটু ভাবি—আমার চারপাশে কেউ কি আজও না খেয়ে আছে? কারো সন্তানের মুখ কি আজও শুকনো?

কারণ ঈদ শুধু নামাজের উৎসব নয়। ঈদ হলো হৃদয়ের উৎসব—যেখানে সকল শ্রেণি, সকল মানুষ একসাথে বলে, “আমরা একসাথে।”

ঈদ হোক সেই ভালোবাসার গল্প—যা শুরু হয় একজন মানুষের হাসি দিয়ে, আর ছড়িয়ে পড়ে হাজারো হৃদয়ে।