img

পাসপোর্ট হাতে একজন শিক্ষক পিছনে ছিল নীল বিদ্রোহের ছায়া

প্রকাশিত :  ০৫:১২, ২৮ মে ২০২৫

পাসপোর্ট হাতে একজন শিক্ষক পিছনে ছিল নীল বিদ্রোহের ছায়া

মঈন কাদেরী

লন্ডনঃ ১৯৩০ সালের এক বর্ষণমুখর দিনে, কলকাতার ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অফিসের সামনে এক বাঙালি স্কুল শিক্ষক দাঁড়িয়ে ছিলেন। নাম রাহমত আলী। তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল একটি কালো বাঁধাই করা ব্রিটিশ  ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট, যার ওপর স্পষ্টভাবে লেখা ছিল ‘British Subject’। তবে তিনি কোনো বিদেশ যাত্রার অপেক্ষায় ছিলেন না। এই পাসপোর্ট ছিল তাঁর হাতে তুলে দেওয়া এক নৈতিক অধিকার, হাজারো নিপীড়িত কৃষকের হয়ে সত্য উচ্চারণের অধিকার। তাঁর এই যাত্রা ছিল না ভৌগোলিক, বরং ন্যায়বিচারের পথে এক প্রতীকী অগ্রযাত্রা। রাহমত আলীর শেকড় পাবনা জেলার এক কৃষক সমাজে। সেই সমাজ বহু আগেই ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে  “পাবনা ভাড়াটে বিদ্রোহ” (১৮৭৩–৭৬) এর মধ্য দিয়ে। জমিদারদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কৃষকেরা তখন শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। এর ফলেই ১৮৮৫ সালে পাস হয় বেঙ্গল টেন্যান্সি অ্যাক্ট, যা কিছুটা হলেও ভাড়াটেদের অধিকার নিশ্চিত করে।  ১৯৩০ সালে নীল চাষের নিপীড়নের কথা আর চাপা ছিল না। ব্রিটিশরা নীল গাছ চাষে কৃষকদের বাধ্য করতো, যা খাদ্য ফসলের জায়গা দখল করে নিত। এতে কৃষকরা দরিদ্র, ঋণগ্রস্ত এবং ক্ষুধার্ত হয়ে পড়তেন। এই শোষণের বিরুদ্ধেই রাহমত আলীর লড়াই। তিনি যাত্রার আগে দেখা করেন একজন বর্ষীয়ান আইনজীবীর সঙ্গে,মাওলভী আজহার আলী মিঞা। তিনি পাবনার শাতবিলা গ্রামে জন্মগ্রহণকারী একজন প্রখ্যাত মুসলিম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। কলকাতা হাইকোর্টের অভিজ্ঞ প্লীডার হিসেবে সুপরিচিত আজহার আলী মিঞা ১৯৩৭ সালে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির পাবনা পূর্ব (গ্রামীণ) মুসলিম কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হন।  মাওলভী আজহার আলী মিঞা ১৯৩৭ সালের অফিসিয়াল বেঙ্গল বিধানসভা রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত আছেন।

তিনি রাহমত আলীকে বলেছিলেন:  “তুমি সত্যের সন্ধানী এক ভূমির সন্তান। স্পষ্টভাবে কথা বলো। তোমার হাতে যে সত্য আছে, তা গুরুত্বপূর্ণ।”  রাহমতের এই লড়াইয়ে পাশে দাঁড়ান এলিজা মার্টিন, The Statesman-এর এক তরুণী ব্রিটিশ সাংবাদিক।  The Statesman ব্রিটিশ ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা, যা কখনো কখনো গ্রামীণ ভারতীয়দের দুর্দশার চিত্র সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরত। যদিও সম্পাদক তাঁকে নিরপেক্ষ থাকতে বলেছিলেন, রাহমতের বয়ান এবং শত শত গ্রামবাসীর চিঠি পড়ে তিনি আর নিরব থাকতে পারেননি এলিজা রাহমতের সঙ্গে পাবনায় গিয়ে নিজ চোখে দেখেন নীল চাষের ভয়াবহতা। তিনি সাক্ষাৎ করেন আমিনা বেগম নামের এক বিধবার সঙ্গে, যাঁর স্বামী চুক্তিভিত্তিক নীল চাষে নিপীড়নের ফলে মারা যান।  তিনি শিশুদের হাতের উপর নীল দাগ, ফাঁকা খাদ্যভাণ্ডার, ক্ষুধার্ত চাষির চোখ দেখেন।  একজন হিন্দু পুরোহিত স্বীকার করেন:  “আমি কখনও ভাবিনি, নীল এতটা বিষ হয়ে উঠবে।”   এই অভিজ্ঞতা থেকে এলিজা মার্টিন The Statesman-এ একটি প্রতিবেদন লেখেন— শিরোনাম ছিল: “Blood of the Indigo Fields” (বাংলা: নীল ক্ষেতের রক্ত)।  প্রতিবেদনটি কলকাতা ছাড়িয়ে পৌঁছায় লন্ডনের ব্রিটিশ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের টেবিলে।  প্রতিবেদনটি প্রচণ্ড আলোড়ন তোলে। ব্রিটিশ সরকার চেয়েছিল বিষয়টি চেপে রাখতে,   কিন্তু এলিজা ও রাহমতের সংগ্রাম সত্যকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে।   ফলে ১৯৪০-এর দশকের শুরুতেই জোর করে নীল চাষ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে।   অবশেষে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান পৃথক হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। এই পটভূমির মাঝে রাহমত আলীর সেই পাসপোর্ট কখনো ব্যবহৃত হয়নি বিদেশযাত্রার জন্য।  তবুও তার প্রতিটি পৃষ্ঠা ছিল বাঙালির দুঃখ ও প্রতিরোধের ইতিহাসের নিরব বাহক। তাঁর এই ক্ষুদ্র পদক্ষেপ ভবিষ্যতের জন্য রেখে গেছে এক চিরন্তন বার্তা।  নিরুদ্দেশ ইতিহাসের স্মৃতি এখনো জীবিত—জনশ্রুতি জানাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।  পাবনারই এক পাঠক জানিয়েছেন:  “আব্বার কাছ থেকে অনেক গল্প শুনেছি। আমাদের পাড়ায় নীল কুঠির সাহেবের বড় একটি প্রাসাদ ছিল। বাড়ির পাশের গলির নাম ছিল ‘হাউজ পাড়া’। সেখানে বিশাল বিশাল হাউজ ছিল, যেখানে নীল গাছ ভিজিয়ে রাখা হতো। আমি নিজেও সেই প্রাসাদ ও হাউজের কিছু অংশ দেখেছি। সরকার এগুলো রক্ষা করেনি। বাড়িটি সম্ভবত ১৯৮৭/৮৮ সালের দিকে দখল করে ভেঙে ফেলা হয়।  হাউজ পাড়ার অনেক বাড়িতে তখনকার বড় বড় ইটের তৈরি হাউজের কিছু অংশ এখনও বাড়ির আঙিনার ওয়াল হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে।” এই মন্তব্য প্রমাণ করে, ইতিহাস শুধু বইয়ে নেই—মানুষের স্মৃতিতে এখনও তা জ্বলজ্বলে।

তথ্যসূত্র ও প্রাসঙ্গিক পটভূমি:  • নীল চাষ: কৃষকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বাণিজ্যিক রঞ্জন গাছের চাষ, খাদ্য উৎপাদনের বিপরীতে ব্যবহৃত হতো। • পাবনা ভাড়াটে বিদ্রোহ (১৮৭৩–৭৬): জমিদারি শোষণের বিরুদ্ধে এক শান্তিপূর্ণ কৃষক আন্দোলন।  • বেঙ্গল টেন্যান্সি অ্যাক্ট ১৮৮৫: কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রণীত আইন। • মাওলভী আজহার আলী মিঞা (১৮৮০–১৯৬১): পাবনার শাতবিলা গ্রামের প্রখ্যাত মুসলিম আইনজীবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ১৯৩৭ সালের বেঙ্গল বিধানসভা সদস্য।  • The Statesman: ব্রিটিশ ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা, যা কখনো কখনো গ্রামীণ বঞ্চনার চিত্র সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরতো। 

• সূত্রসমূহ: • Bengal Legislative Assembly Proceedings, 1937, archive.org  • পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা সদস্য তালিকা, lalib.wb.gov.in • সূত্র: Bengal Legislative Assembly Proceedings, 1937, archive.org • সূত্র: পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা সদস্য তালিকা, lalib.wb.gov.in.

( লেকখঃ মঈন কাদেরী -ব্রিটিশ বাংলাদেশী মেয়র লন্ডন বরো অব বার্কিং এন্ড ডাগেনহ্যাম। )

img

নজরুল-চিন্তা ও আগামীর বাংলাদেশ

প্রকাশিত :  ১৯:০৪, ০৪ জুলাই ২০২৫

জয়দ্বীপ রায়

আমি মাঝে মাঝে ভাবি—আজ যদি কবি নজরুল ইসলাম জীবিত থাকতেন, তবে তিনি কী করতেন? যদিও এই প্রশ্নটি স্থান, কাল ও পাত্রের সূচকগুলোকে বিবেচনায় না নিয়েই করা হচ্ছে, তারপরও কিছু আকাঙ্ক্ষা মনের গভীর থেকে উঠে আসে, যা প্রকৃতি প্রদত্ত কিছু সত্য উপলব্ধির ফসল।

আমার মতে, এটি একটি যুক্তিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক মতও বটে যে নজরুল ইসলাম, একজন ধর্মপরায়ণ পরিবারের সন্তান হয়েও ধর্মের মূল উদ্দেশ্য—মানবকল্যাণ—উপলব্ধি করেছেন জ্ঞান, যুক্তি ও ঈশ্বর-চেতনার মাধ্যমে। তাইতো তিনি লিখেছেন:

“খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে,

প্রলয়-সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে, প্রভু নিরজনে...”

এই উপলব্ধি কোথা থেকে এসেছে? আমার ধারণা, ঈশ্বরের করুণা ব্যতিরেকে এমন চিন্তা সম্ভব নয়। তবে এটাও আমার বিশ্বাস—সারাক্ষণ ঈশ্বরচিন্তা করলেও তাঁর করুণা সবসময় নাও আসতে পারে। এখানে গ্রন্থগুলোতে ঈশ্বর যেখানে মানুষের মানবতাকে মূল্য দিয়েছেন, সেই ধর্মীয় উপলব্ধির গভীরতাই নজরুলকে অনন্য করে তোলে।

নজরুল এক অনন্য মাত্রায় ঈশ্বর ও মানবতার সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। তিনি সব ধর্মের প্রতি সম্মান রেখেছেন এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে নিজের জীবনে ধারণ করেছেন। তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা নয়, বরং অসীম ঈশ্বরের প্রতি তাঁর বিনীত নিবেদন ও আনুগত্য, যেখানে তিনি সকল ধর্মের ঈশ্বরের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে ইসলামি ধর্মীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তিনি যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা একজন অমুসলিম পাঠকের মনেও ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা ও সংবেদনশীলতা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম—যেমনটি দুই বাংলাতেই আমাদের বাঙালি মননে অনেকের মধ্যেই ঘটেছে।

নজরুলের এই সাহিত্য-শক্তির কারণেই তাঁর ধর্ম, নানান সংস্কৃতি ও বিশ্বময় বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি করে। তিনি এতটাই বৈচিত্র্যে আকৃষ্ট সাহিত্যিক ছিলেন, যিনি সারা পৃথিবীর বৈচিত্র্যকে তাঁর সৃষ্টিতে ও জীবনবোধে এক বৈশ্বিক রূপ দিয়েছেন। যেখানে ছিল না কোনো গণ্ডি ও সংকীর্ণতা। একজন কবি এত দারিদ্র্য ও সীমাবদ্ধতার মাঝেও কোনো অভিযোগ ছাড়াই কী রকম মুক্তমন নিয়ে নিজেকে বিকশিত করেছিলেন, আর বাঙালি মননকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় শুদ্ধ করেছিলেন।

বাংলা সাহিত্যে নজরুলের মতো করে শ্যামাসঙ্গীত, ভজন বা সনাতন ধর্মীয় গানে মৌলিক অবদান আর কেউ রাখেননি। এই বৈচিত্র্যই তাঁকে তুলনার ঊর্ধ্বে স্থাপন করে। সাহিত্যের প্রতিটি শাখা স্বতন্ত্র—এখানে কারও সাথে কারও তুলনা হয় না, কারণ এই ক্ষেত্রটি বিশাল, যার কোনো কোলকিনারা নেই। এখানে নানান সাহিত্য উপাদান বা কনটেন্ট উপস্থাপনাই গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প ও সাহিত্যের বিজ্ঞানের নিয়মের বিচারে একেক জনের সৃষ্টি একেক জনকে অনন্য সাধারণ হিসেবে স্থান করে দিয়েছে।

উপনিবেশিক রাজনীতির সংকীর্ণ প্রয়োজনে যখন হিন্দু-মুসলমান বিভাজন সমাজে প্রকট হয়ে উঠল—যা মুঘল আমলেও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় ছিলই না—তখন নজরুল হয়ে উঠলেন জাতির বিবেক। তিনি শুধু কবিই ছিলেন না, ছিলেন সাম্যবাদী চিন্তাবিদ, রাজনৈতিক ও সমাজকর্মী। বিপ্লবী রাজনীতিবিদদের সাংস্কৃতিক মানের প্রশ্নে তিনি তাদেরকে তাঁর সাহিত্যরস দিয়ে পরিচালিত করেছেন, শক্তি জুগিয়েছেন।

সম্প্রতি নজরুলের জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কিছু সমসাময়িক রাজনৈতিক নেতা তাঁকে স্মরণ করে বাণী দিয়েছেন। এটি প্রশংসনীয়। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম—সাম্য, বিদ্রোহ, শোষণবিরোধিতা ইত্যাদি—সব শব্দই ব্যবহৃত হয়েছে, শুধু “অসাম্প্রদায়িকতা” শব্দটি নেই। কেন? এই শব্দ ব্যবহার করলে কি বেশিরভাগ সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন মানুষগুলোর বিশ্বাসে আঘাত আসতে পারে? এই বিশ্বাস কি তার ধর্মীয় চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক? না তার অজ্ঞানতা বা না বোঝার ফলে বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে আজ সংক্রামিত হয়েছে? আমার মতে, এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কবি নজরুলকে বোঝা খুবই গুরুত্ব বহন করবে।

অসাম্প্রদায়িকতা কি সাম্যের অংশ নয়? অন্য ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর প্রতি সম্মান, নারীর সমমর্যাদা, ধর্মভিত্তিক বৈষম্য রোধ—এগুলো কি সাম্যের পরিপূরক নয়? তাহলে নজরুলের সাম্যের দর্শনে এই বিষয়গুলো কি অনুপস্থিত থাকবে, যারা এই শব্দগুলো ব্যবহার করছেন?

আমরা সবাই জানি, নজরুল ভারতের কবি হলেও বাংলাদেশ তাঁর শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার পেয়েছে। এই পাওয়া আমাদের জন্য বাড়তি পাওয়া, কিন্তু ভারতের অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষদের ক্ষোভ আছে এই বিষয়ে। এই অমূল্য রত্নকে যদি শুধু রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করি—সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি বাদ দিয়ে কেবল দলীয় ব্যাখ্যায় ব্যাখ্যাত করি—তাহলে আমরা আসলে কী শিখছি? ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকেও কি এমনটাই শেখাব?

এই প্রশ্নগুলোর সাথে ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও জাতিসত্তাভিত্তিক বাংলাদেশের ভাগ্য জড়িত। তথাকথিত \"বহুত্ববাদ\"ও এই প্রশ্নগুলোর সাথেই সম্পর্কিত।

বহুত্ববাদ মানে শুধু কারও ওপর ঘটে যাওয়া অন্যায় শুধরে দেওয়া নয়—বরং সকল মত, জাতি ও ধর্মের সহাবস্থান নিশ্চিত করা। নিজের বিশ্বাসকে অন্যের ওপর চাপিয়ে না দেওয়ার সহিষ্ণুতা। এই বহুত্ববাদই বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য। এই ভূখণ্ডে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান—সবাই যুগে যুগে ধর্ম প্রচার করেছেন, আবার সহঅবস্থানেরও দৃষ্টান্ত রেখেছেন।

সভ্যতা এগিয়ে যাওয়ার কথা বলে, পেছনে ফিরে যাওয়াকে কখনো উৎসাহ দেয় না। তাই বাঙালির প্রকৃত পরিচয়—বৈচিত্র্য-বিশ্বাসী ও পরমত সহিষ্ণু জাতি—যদি জোর করে চেপে ধরা হয়, তবে প্রকৃতি একদিন এর প্রতিক্রিয়া দেবে—যা আমাদের জন্য কল্যাণকর হবে না।

এটাই সামাজিক বাস্তবতা।

গণতন্ত্রে বিশ্বাস যদি সত্যিই কেউ করে, তাহলে তা কখনোই সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী বা ধর্মীয় সহিষ্ণুতাকে অবজ্ঞা করে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সুইজারল্যান্ড মাত্র কয়েক হাজার ইতালিয়ান ভাষাভাষীর জন্য রোমানশ ভাষাকে জাতীয় ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। আমরা ইউরোপে থাকি, কিন্তু ইউরোপ থেকে কী শিখছি? দেশে কী ফিরিয়ে নিচ্ছি? নজরুলের কথা বলছি, কিন্তু তাঁকে বুঝে? না না বুঝে?

যুক্তরাজ্য থেকে আইনে ডিগ্রি নিয়ে ব্যারিস্টার হয়ে অনেকেই দেশে রাজনীতি করছেন বা করবেন, কিন্তু দেশে গিয়ে বিদেশের সোনা লোহা হয়ে যায় কেন? এটা সামাজিক বাস্তবতার কাছে আত্মসমর্পণ করে অস্বীকার করা নয়, যুক্তির কষ্ঠিপাথরে থেকেও নিজের সাথে প্রতারণা করে অবিশ্বাস করা।

আগামী দিনে যারা রাজনীতি করবেন, তাদের নৈতিকতাবোধ কি বিবেচনায় আসবে না? যদি না আসে, তাহলে কি আমরা একই বৃত্তে ঘোরপাক খাবো? আগাবো না?

এই প্রশ্নগুলো আজকের বিশ্বায়িত রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির যুগে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


জয়দ্বীপ রায়: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংস্কৃতি কর্মী, লন্ডন।