ভ্রমণ আখ্যান

img

নীলনদের কাব্য

প্রকাশিত :  ১৭:০৬, ৩১ জুলাই ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৭:৫৮, ৩১ জুলাই ২০২৫

নীলনদের কাব্য

দিলু নাসের

এখন গভীর রাত, মিশরের প্রাচীন লুক্সর নগরে নীলনদের দুইপাড় ঘুমিয়ে পড়েছে, ঘুম নেই শুধু নদীর চোখে। সে ছুটে চলেছে দেশ থেকে দেশান্তরে। বহতা এই নদী-উপত্যকাতেই বহুযুগ আগে গড়ে উঠেছিল মানুষের আদিম সভ্যতা।

মধ্য আফ্রিকার ভিক্টোরিয়া হ্রদ থেকে জন্ম নিয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম এই নদী। আরবিতে এর নাম নহর আন - নিল। মিশরের ইতিহাস আর প্রকৃতি এই নীলনদকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে।

নীলনদের দুই তীরে আজও অক্ষত রয়েছে প্রাচীন নদী-সভ্যতার একাধিক নিদর্শন। এই নদীর দুই তীরে রয়েছে নেফারতিতি, বিবি জুলেখা আর ক্লিওপেট্রার পদছাপ।

রাতের অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে নদীর পরিচ্ছন্ন টলটলে জল। কানে ভেসে আসছে রাত জাগা পাখিদের কলকাকলি । মাঝ নদীতে দাঁড়িয়ে আছে পর্যটক বোঝাই কয়েকটি প্রমোদতরী, ভেতরে মিটি মিটে আলো। বাতাসে নীলনদীর কলকল শব্দে আমার কানে ভেসে আসে তার জন্ম-কাহিনি।

সুদূর অতীতে উগান্ডার ভিক্টোরিয়া লেক থেকে জন্ম নিয়েছিল ‘হোয়াইট নাইল‘-এর একটি উৎস, অন্য দিকে ইথিওপিয়ার টানা হ্রদ থেকে ‘ব্লু-নাইল‘-এর আরেকটি উৎস বের হয়েছিল অসীম কৌতূহলে। চলতে চলতে এই দুই নদীর দেখা হয় সুদানের রাজধানী খার্তুমে। এদের মিলিত ধারা মিশরে ঢুকে পড়ে আসোয়ানের নাসের হ্রদের কাছে। এরপর ২০০০ কি.মি. পথ অতিক্রম করে, দুপাশের মরুভূমিকে উর্বর করতে করতে লীন হয় ভূমধ্যসাগরে। চলার পথে এই নদী সমৃদ্ধ করেছে আফ্রিকার ৯টি রাষ্ট্র বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা, তানজানিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা, কঙ্গো, সুদান, ইথিওপিয়া ও মিশরকে।

এই নদীর সাথে জড়িয়ে আছে মানব সভ্যতার অজস্র ইতিহাস। গ্রিক কবি হোমার তাঁর লেখা মহাকাব্য ‘ওডিসি’তে নীলনদকে ইজিপ্টাস নামে অভিহিত করেছেন। এই নদীর সাথে মিশে আছে হজরত ইউসুফ আঃ হজরত মুসা আঃ এবং আমেনহোটেপ রামাসেস,আলেকজান্ডার সহ বহু কীর্তিমান মানুষের স্মৃতি।

সুদূর উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার বুক চিরে বয়ে চলা পৃথিবীর দীর্ঘতম এই নদী, নীলনদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিলো কয়েক বছর আগে কায়রোতে, কিন্তু ব্যস্ত নগরী কায়রোর নীলনদ দেখে তৃষ্ণা মিটেনি, দেখে মনে হয়েছে টেমস অথবা রাইনের মত। আমার এক মিশরীয় বন্ধু বলেছিলেন নীলনদের সৌন্দর্য দেখতে হলে লুক্সর অথবা আসোয়ান যেতে হবে তোমাকে । এমনিতেই লুক্সর আর আসোয়ান ভ্রমণের ইচ্ছে আমার অনেক দিনের। কারন এখানে নীলনদের দুই তীরে আজও অক্ষত রয়েছে প্রাচীন নদী-সভ্যতার একাধিক নিদর্শন।

একসময় লুক্সর ছিল প্রাচীন মিশরের ধর্মীয় রাজধানী নাম ছিলো থিবস এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানব সভ্যতার এক অনন্য সমৃদ্ধ ইতিহাস। ইতিহাসের গন্ধমাখা এই লুক্সর নীল নদের পূর্ব এবং পশ্চিম তীর এলাকায় বিভক্ত। প্রাচীনকালে এই দুই এলাকা যথাক্রমে জীবন ও মৃত্যুকে বোঝাত। কেননা জনবসতি গড়ে উঠেছিল নীল নদের পূর্ব তীরে এবং সেখানেই ফারাওরা গড়ে তুলেছিল রাজধানী শহর, রাজমন্দির এবং অন্যান্য স্থাপনা।অন্যদিকে পশ্চিম তীরের বিরান পাহাড়ী জায়গায় নির্মিত হয়েছিল ফারাওদের সমাধি।

রাতের মায়াময় আলোয় আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি পূর্ব লুস্করে নীলনদের তীর ঘেষা পাঁচ তারাকা শেরাটনের নিজস্ব জেটির পাশে। নীলনদের রাত্রির শোভায় আকাশের ঝলমলে চাঁদকে দেখে মনে হলো চাঁদের আলোয় যেন নীল নদ স্নান করছে এই অনুভব বড় মূল্যবান হয়ে ধরা দিল আমার হৃদয়ে।

গতকাল দুপুরে এসেছি এখানে। পর্যটন নগরী হুরগুদা থেকে সড়ক পথে লুক্সর আসতে সময় লেগেছে প্রায় চারঘন্টা। ধু-ধু মরুভূমির বুক চিরে ছুটে চলেছে কালো পিচের হাইওয়ে। যেদিকে দু-চোখ যায় শুধু বালি আর বালি। নেই বসতি, নেই জনজীবন, নেই আড়ম্বর, আছে শুধু পাথরের টিলা । আমাদের গাড়ি ছুটেছে ঝড়ের গতিতে। মসৃণ রাস্তার দুপাশে বিশ্বের বৃহত্তম মরুভূমি সাহারার লালচে বালির রুক্ষ্ম প্রান্তর। মাঝে মাঝে প্রায় সমতল মরুভূমির কোথাও কোথাও অল্প বালিয়াড়ি ও কাঁটাগুল্ম দেখা যাচ্ছে। এখন মে মাস, মরুভূমির গরম কাল শুরু হয়ে গেছে । বালি উত্তপ্ত।

ধুধু মরুর বুক চিড়ে প্রায় তিন ঘন্টা দুরন্ত গতিতে ছুটতে ছুটতে এক সময় চোখে পড়লো পথের দু'পাশের মিশরীয় গ্রাম, জনপদ, জলাশয়, চাষজমি । মিশরের এই সব পথের ধারের দৃশ্য যেন একদম আমাদের চিরপরিচিত গ্রামবাংলার মত। পথের ধারের জমিগুলোতে আলু, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, ধনেপাতা চাষ হয়েছে দেখতে পেলাম। নীল নদের অববাহিকায় এই সব গ্রাম, জনপদগুলো হওয়ায় চাষে সমৃদ্ধ ও সুন্দর হয়ে আছে দু'পাশ। দেখলাম রাস্তার কিছু দূরে বয়ে চলেছে নীলনদ। তার ঘন নীল জলরাশির চারপাশে মনোরম প্রাকৃতিক শোভা। রুক্ষ টিলা পাহাড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সবুজ গাছগাছালি। মিশরের এই এলাকার এমন প্রাকৃতিক বৈপরীত্য নীলনদেরই দান। মরু প্রকৃতির সঙ্গে বিরাজমান নীল নদের দুকূল জোড়া সবুজ প্রান্তর। আদিগন্ত ধূসরের মাঝে এই টুকরো টুকরো সবুজ শস্যক্ষেত্র দেখে মন জুড়িয়ে গেলো।

দু'পাশের গ্রাম, জনপদ দেখতে দেখতে চলেছি। নীলের জলে অনেক জেলে ডিঙ্গি চোখে পড়ল। নীলনদে অনেক রকম মাছ নাকি পাওয়া যায়। জাল ছুঁড়ে ছুঁড়ে জেলেরা মাছ ধরছে। পথের ধারে গরু চরে বেড়াচ্ছে। বাচ্চারা খেলছে। মাঠে চাষ হচ্ছে। পাখির দল উড়ে বেড়াচ্ছে। কখনো কখনো মনে হচ্ছিল, মিশরে নয় যেন চির চেনা বাংলার কোনো জনপদ দিয়ে যাচ্ছি।

লুক্সরে নির্ধারিত হোটেলে এসে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে যখন রুমে আসলাম তখন ঘড়ির কাটা বিকেল ৪টা ছুঁই ছুঁই করছে। শেরাটনের দুতলার রুমে ঢুকেই সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়ে মুছে দিলো বাইরের দৃশ্য। প্রসস্ত ব্যালকনিতে এসে বসলাম।চোখের সামনেই বয়ে চলছে নীলনদ। উঁকি মারলাম নীলনদে৷ সেই ছোটোবেলা থেকে পদ্মা-মেঘনা সুরমার পরে সবচেয়ে পরিচিত নদী বোধহয় নীলনদ৷ পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত নদী দেখেছি কিন্তু নীলনদ দেখে অদ্ভুত লাগছিলো৷ একটা নদী, যে নদী এতোদিন শুধু কল্পনাতেই ছিলো - সেই নদী চোখের সামনে৷ পৃথিবীর দীর্ঘতম এই নদী - এই নদীর বুকে গড়ে উঠেছে প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত মানবসভ্যতা৷ সেই মানুষেরা এমন কাজ করে গেছে যা আমরা আজকের দিনেও করার কথা ভাবতেও পারবো না৷

নীলের স্নিগ্ধ হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। চেয়ে দেখলাম শান্ত, সুনীল, স্বচ্ছ এক স্রোতস্বিনীকে যার মধ্যে নেই কোনো ঢেউয়ের তোলপাড়, ঘোলা জলের তীব্র স্রোত,শুধু কুল কুলু রবে একই ভাবে বয়ে যাচ্ছে সেই আদি অনন্ত যুগ ধরে।

নদীর পাড়ে হোটেলের চমৎকার বাঁধানো ঘাট। জলে ভাসছে রং-বেরঙের জাহাজ আর বাহারি নৌকা। পরন্তু দুপুরে চোখ আটকে গেল নদীর বুকে। ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে বিশাল বিশাল সাদা পালতোলা কাঠের নৌকা। এই নৌকাগুলিই তাহলে এতদিনের ছবিতে দেখা মিশরিয় ঐতিহ্যবাহী ফেলুকা!

হাওয়ায় হাওয়ায় শিহরণ লাগে শরীরে। নদীর বুকে ভাসছে ফেলুকা। তাদের দীর্ঘ পালগুলি দুলে দুলে অবিরাম কানাকানি করছে বাতাসের সঙ্গে। বেশ কয়েকটি ক্রুজ চলেছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে, উত্তর থেকে দক্ষিণে। ছোট কাঠের নৌকা বাইছে একলা মাঝি।

আমাকে আলোড়িত করে নীলের টলটলে জলের গভীর মায়া। মাঝে মাঝে জলে এসে ঝাপ দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে কয়েকটি বালিহাঁস আর সীগাল। আমার ভাবতে রোমাঞ্চ লাগছে, ফারাও সম্রাট আমেনহোটেপ, নবী ইউসুফ, রামাসেস, নবী মুসা আর বিশ্বখ্যাত আলেকজান্ডার ও ক্লিওপেট্রার স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক নীলনদ আমার চোখের সামনে। এই জলে বয়ে চলছে কত ইতিহাস৷ আছে কত মানুষের দীর্ঘশ্বাস৷

ফেলুকায় চড়ে নীলনদের সূর্যাস্ত দেখার ইচ্ছা আমাদের, তাই রুমে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আমরা চলে আসলাম নীচে। হোটেলের সুইমিং পুল এবং বাগানের সাথেই নীলনদ সেখানে হোটেলের নিজস্ব জেটি এর পাশেই কয়েকজন মাঝি ফেলুকা নিয়ে অপেক্ষা করছে পর্যটকদের। আমাদেরকে দেখে একজন বয়স্ক লোক ডাকাডাকি শুরু করলেন তার নৌকায় যেতে। সূর্যাস্তের আর বেশী সময় বাকি নেই তাই আমরা তার ডাকেই সাড়া দিলাম। হোটেলের পাশের নৌকা থেকে উঠলে মাঝিরা সাধারণত বেশী পয়সা চায় কিন্তু তিনি যা বললেন তাতে গৃহিনী রাজি হয়ে গেলেন। এক ঘন্টায় তাকে দিতে হবে দুইশত ইজিপশিয়ান পাউন্ড। বৃটেনের পাউন্ডে প্রায় চার পাউন্ড। যেহেতু আমরা এই হোটেলের কাস্টমার তাই তিনি খুব যত্ন সহকারে আমাদেরকে নৌকায় তুললেন। ফেলুকায় উঠে দেখলাম ফেলুকার মাঝি পৌঢ় লোকটির দুই ছেলে। একজনের বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ আরেক জন বারো তেরো বছরের। বড় ছেলের নাম ইউসুফ ছোটটি ওসামা। ফেলুকার কাঠের পাটাতনে আরামদায়ক বসার জায়গা। আমরা বসতেই চটপটে ওসামা নৌকায় পাল তুলে দিলো আর ইউসুফ হাল ধরলো শক্ত হাতে। দুজনই হাসিখুশি উচ্ছল। প্রথম দেখাতেই আমাদের ভালো লাগলো দুইভাইকে।

বিকালের হাওয়ার টানে ভেসে চলেছে ফেলুকা। প্রায় ৩০-৪০ ফুট দীর্ঘ সাদা পালের নৌকাগুলি এখানকার বৈশিষ্ট্য। দাঁড় বায় দুজন, আর নৌকা চলে হাওয়ার টানে। দেখতে দেখতে মাঝনদীতে চলে এসেছি, চারপাশে কাচের মতো স্বচ্ছ সবুজাভ জল। নদীর এক পাড় সবুজ, অন্য পাড়ে দোকানপাট অভিজাত হোটেল। নীলনদের দুইপাড় ইস্ট ব্যাংক এবং ওয়েস্ট ব্যাংক নামে খ্যাত।

পূর্ব পাড়ে আলো ঝলমলে নগরী আর পশ্চিম তীরের সবুজ গাছগাছালির অদূরে বিরান পাহাড়ী জায়গায় নির্মিত ফারাওদের সমাধি।

হাওয়ার টানে আমাদের নৌকা চলে এসেছে অনেক দূরে। দেখলাম নদীর মাঝখানে ছোট ছোট দ্বীপের মতো সবুজ ঝোপঝাড়। পশ্চিম পাড়ে কোথাও গাছ ঝুঁকে স্পর্শ করতে চাইছে নদীকে, কোথাও রচনা করেছে বনরাজি। চোখে পড়লো কলা আর আমের বাগান কাঁচা আম ঝুলে আছে গাছে গাছে।নদীতীরের নিরালা গ্রাম, চাষের খেত চোখে পড়ল। নদীর পরিচ্ছন্ন টলটলে জল। কানে ভেসে আসছে পাখির ডাক। নদীতীরের এই সবুজ প্রকৃতিকে টপকালেই মরুভূমির হাতছানি।

হাওয়ার টানে তর তর করে জল কাটিয়ে ভেসে চলেছে আমাদের ফেলুকা।নৌকার পাল হাওয়ায় উড়ে যেতে চাইছে আকাশের দিকে। বেলা শেষ হয়ে আসছে, দিনান্তের সবটুকু আলো মেখে নিয়ে নীলনদ এখন মায়াবি। স্বপ্নীল নদীর বুকে ছমছমে রহস্য আমার জল ভ্রমণের মুগ্ধতা বাড়িয়ে দিল।আমার ভাবতে রোমাঞ্চ লাগছে, ইতিহাসে পড়া আর টেলিভিশনে দেখা নীল নদী আমার চোখের সামনে আমি ভেসে চলছি তার জলে রোমাঞ্চকর জল ভ্রমণে।

ওসামা আমাদেরকে পুদিনা পাতার চা বানিয়ে দিলো। ইউসুফ শোনালো স্থানীয় লোকগান।

আমি যখন নীলের মুগ্ধতায় মগ্ন তখন গৃহিনী ওসামা আর ইউসুফের সাথে গল্পে ব্যস্ত। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনছেন তাদের জীবনগাঁথা। ফেলুকার মাঝি হলেও তারা কিছুটা ইংরেজি বলতে পারে তাই তাদের সাথে কথা বলতে আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না।তাদের মা নেই দুইভাই বাবা এবং সৎমায়ের সাথে থাকে। ওসামা দিনে স্কুলে যায় বিকেলে ভাইয়ের সাথে ফেলুকা চালায়। উইসুফ তার পছন্দের মেয়েকে অচিরেই বিয়ে করবে তাই বাড়তি আয়ের জন্য বাবার নৌকা চালায়। বাবার বয়স হয়েছে তাই দাড় বাইতে পারেননা শুধু ঘাটে হেঁটে হেঁটে কাস্টমার জোগাড় করেন।গৃহিনী তাদের গল্প শোনে দুইভাইয়ের হাতে কিছু বৃটিশ পাউন্ড তুলে দিলেন। কথা হলো পরের দিন তাদের সাথে আবারো আমরা নীল ভ্রমন করবো।

এমন মায়াময় প্রকৃতির কোলে বিকেলের জলে টুইটুম্বুর নীলনদে মিশরের ঐতিহ্যবাহী পালতোলা ফেলুকায় বসে সবুজ প্রকৃতি আর নদীর সাথে গল্প করতে করতে এক সময় দিন শেষ হয়ে আসে, বিদায় নেবার আগে দিবাকর তার সবটুকু আলো ঢেলে দেয় নদীর বুকে। পড়ন্ত বেলায় সিগালেরা চেঁচামেচি করে জানান দেয়, নীড়ে ফিরতে হবে। নদী তীরের লুক্সর সেজে উঠেছে আলোকসজ্জায়। নীলাভ জলে দেখা গেলো সূর্যের মায়াবী আলোর ঝিকিমিকি। আমরা আমাদের হোটেলে জেটিতে পৌঁছানোর আগেই সুর্য নীলনদকে আলিঙ্গন করে ডুব দিলো দিকচক্রবালের ধূসর আড়ালে। আর একরাশ ভালোলাগা বুকে নিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম বিলাসবহুল শেরাটনের আলো ঝলমলে অন্দরে।


img

বাংলাদেশের ইতিহাসে রাণী ভবানী ও নাটোর রাজবাড়ী: অর্ধবঙ্গেশ্বরীর গৌরবগাথা

প্রকাশিত :  ০৯:২৫, ০৪ নভেম্বর ২০২৫

সংগ্রাম দত্ত

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত নাটোর জেলা একসময় ছিল রাজকীয় ঐশ্বর্যের কেন্দ্রস্থল। এই জেলার সদর উপজেলায় অবস্থিত বিখ্যাত রাণী ভবানী রাজবাড়ী, বাংলার ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়ের সাক্ষী। জমিদারি প্রথার উত্থান-পতনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই রাজবংশের নাম, যেখান থেকে এক নারী – রাণী ভবানী – সমগ্র বাংলার “অর্ধবঙ্গেশ্বরী” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

নাটোর রাজবংশের সূচনা: অষ্টাদশ শতকের শুরুতে নাটোর রাজবংশের যাত্রা শুরু হয়। ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে পরগণা বানগাছির জমিদার গণেশ রায় ও ভবানীচরণ চৌধুরী রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হয়ে চাকরিচ্যুত হন। তাঁদের জমিদারি কেড়ে নিয়ে দেওয়ান রঘুনন্দন তাঁর ভাই রামজীবনের নামে বন্দোবস্ত নেন। এই রামজীবনই ছিলেন নাটোর রাজবংশের প্রথম রাজা।

রাজা রামজীবন ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে) জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৭৩৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর নিজ সন্তান না থাকায় জীবদ্দশায় এক পুত্র দত্তক নেন—রামকান্ত।

রাণী ভবানীর আগমন:১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামজীবনের দত্তকপুত্র রামকান্তের সঙ্গে বিয়ে হয় রাণী ভবানীর। রাজা রামকান্তের মৃত্যুর পর ১৭৪৮ সালে নবাব আলীবর্দী খাঁ রাণী ভবানীর হাতে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন।

রাণী ভবানীর জন্ম ১৭২৩ সালে বগুড়া জেলার আদমদিঘি থানার ছাতিয়ানগ্রাম গ্রামে। তাঁর পিতা আত্মারাম চৌধুরী ও মাতা জয়দুর্গা দেবী। অল্প বয়সেই তিনি রাজবংশের বধূ হিসেবে নাটোরে আসেন।

অর্ধবঙ্গেশ্বরী রাণী ভবানী: রাণী ভবানীর রাজত্বকালে নাটোর রাজবাড়ির প্রভাব বিস্তৃত হয় এক বিশাল অঞ্চলে। তাঁর জমিদারি ছড়িয়ে ছিল বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও মালদহ পর্যন্ত।

ইংরেজ লেখক হলওয়েলের হিসাবে, তাঁর জমিদারি থেকে বার্ষিক রাজস্ব আয় হতো প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা, যা তৎকালীন সময়ের এক বিরাট অঙ্ক। দক্ষ প্রশাসন, প্রজাহিতৈষী মনোভাব ও দানশীলতার কারণে প্রজারা তাঁকে ভালোবেসে “অর্ধবঙ্গেশ্বরী” নামে অভিহিত করেছিল।

প্রজাদের কল্যাণে দানশীল রাণী: রাণী ভবানীর জীবনযাপন ছিল অনাড়ম্বর, কিন্তু সমাজসেবায় তাঁর দৃষ্টান্ত অনন্য। তিনি শত শত মন্দির, অতিথিশালা ও রাস্তা নির্মাণ করেন। প্রজাদের জন্য পুকুর খনন করে পানীয় জলের ব্যবস্থা করেন এবং শিক্ষা বিস্তারে অনুদান প্রদান করেন।

১৭৫৩ সালে তিনি কাশীতে (বর্তমান বারাণসী) ভবানীশ্বর শিব ও দুর্গাবাড়ী, দুর্গাকুণ্ড ও কুরুক্ষেত্রতলা নামক পবিত্র স্থান নির্মাণ করেন। তাঁর উদ্যোগেই হাওড়া থেকে কাশী পর্যন্ত দীর্ঘ সড়কপথ নির্মিত হয়, যা তখন পরিচিত ছিল “রাণী ভবানী রোড” বা “বেনারস রোড” নামে।

ধর্মীয় অবদান ও দেবোত্তর সম্পত্তি: বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার ভবানীপুর শক্তিপীঠ উন্নয়নে রাণী ভবানীর অবদান আজও স্মরণীয়। কথিত আছে, তিনি প্রতি বছর দু’বার হাতি বহর নিয়ে ভবানীপুরে যেতেন।

পাকিস্তান আমলে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও রাণী ভবানী স্টেটের উত্তরাধিকারীরা ২৬২ একর জমি দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে ভবানীপুর শক্তিপীঠের নামে দানপত্রে নিবন্ধন করে দেন। বর্তমানে ঐ জমির একটি বড় অংশ প্রভাবশালী মহলের দখলে চলে গেছে, যার পুনরুদ্ধারে আদালতে একাধিক মামলা চলছে।

তারাপীঠে অবদান ও বামাক্ষ্যাপার নিয়োগ: বীরভূম জেলার বিখ্যাত তারাপীঠ মন্দিরও তাঁর জমিদারির অন্তর্গত ছিল। ভগ্নপ্রায় অবস্থায় থাকা মন্দিরটি তিনি পুনর্নির্মাণ করেন এবং কিংবদন্তি সাধক বামাক্ষ্যাপাকে মন্দিরের পুরোহিত হিসেবে নিয়োগ দেন।

রাণী ভবানীর রাজবাড়ি, স্থাপত্য ও ঐতিহ্য: নাটোর রাজবাড়ি নির্মাণ শুরু হয় ১৭০৬-১৭১০ সালের মধ্যে। রাজবাড়ির আয়তন প্রায় ১২০ একর, যেখানে ছোট-বড় ৮টি ভবন, ৭টি পুকুর, এবং দুটি স্তরের বেষ্টনী প্রাচীর রয়েছে।

রাজবাড়ি বিভক্ত দুই ভাগে—বড় তরফ ও ছোট তরফ। এখানকার প্রধান মন্দিরগুলো হলো শ্যামসুন্দর মন্দির, আনন্দময়ী কালিবাড়ি ও তারকেশ্বর শিবমন্দির।

রাজবংশের রাজধানী স্থাপনের জন্য রামজীবন ভাতঝাড়ার বিল এলাকা নির্বাচন করেন, যা পরবর্তীতে “নাট্যপুর” নাম ধারণ করে “নাটোর” নামে পরিচিত হয়।

জীবনের শেষ অধ্যায়: দত্তক পুত্র রামকৃষ্ণের হাতে জমিদারি দায়িত্ব অর্পণ করে রাণী ভবানী মুর্শিদাবাদ জেলার বড়নগরে চলে আসেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ভাগীরথী নদীর তীরে তিনি নির্মাণ করেন ১০০টি শিবমন্দির, যার কিছু আজও টিকে আছে।

তাঁর মৃত্যুর পর ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁর রংপুরের জমিদারি দখল করেন। দীর্ঘ ও কর্মবহুল জীবনের পর রাণী ভবানী ১৮০২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, ৭৯ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।

বর্তমান অবস্থা: নাটোর রাজবাড়ি আজ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও পর্যটন স্থাপনা। ১৯৮৬ সাল থেকে রাজবাড়ির পুরো এলাকা জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে “রাণী ভবানী কেন্দ্রীয় উদ্যান ও যুবপার্ক” নামে পরিচালিত হচ্ছে।

রাণী ভবানী কেবল নাটোর বা রাজশাহীর ইতিহাসে নয়, সমগ্র বাংলার ইতিহাসে এক আলোকবর্তিকা—যিনি প্রমাণ করেছিলেন, নারীর নেতৃত্বও রাজনীতি ও প্রশাসনে সমান সফল হতে পারে। তাঁর স্মৃতি, দানশীলতা ও প্রজাহিতৈষী মনোভাব আজও বাংলার মাটিতে কিংবদন্তি হয়ে আছে।