
বিনিয়োগকারী লতিফ সাহেব!

রেজুয়ান আহম্মেদ
সকাল ১০টা।
ঢাকার পূর্ব রামপুরার পুরনো এক পাঁচতলা বাড়ির ছোট্ট ফ্ল্যাটে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে জেল দিচ্ছেন কাজী লতিফ সাহেব।
আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে একবার হেসে নিলেন, আবার ভ্রু কুঁচকে নিজের চেহারায় খুঁত খুঁজে দেখলেন। পেছন থেকে স্ত্রীর গলা এল:
— “এই! আজ আবার কোথায় যাবে? চাকরি তো নেই!”
লতিফ গম্ভীরভাবে জবাব দিলেন:
— “চাকরি নেই ঠিক আছে, কিন্তু শেয়ারবাজার তো আছে! আজ বিও অ্যাকাউন্ট খুলতে যাচ্ছি।”
স্ত্রী চোখ বড় করে বললেন:
— “বিও মানে কী?”
— “বউয়ের ঈদের অগ্রিম!” — লতিফ গম্ভীর গলায় রসিকতা করলেন।
স্ত্রী কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “এই বয়সেও ঠাট্টা করাটা ছাড়েনি।”
জুতা পরে গেট দিয়ে বের হতেই নিচতলার রহিম চাচা ধোঁয়াটে গলায় ডাক দিলেন:
— “ওই লতিফ! কোথায় যাচ্ছিস?”
— “চাচা, আমি আজ থেকে বিনিয়োগকারী!”
রহিম চাচা সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হেসে বললেন:
— “জানি, জানি। আমিও একসময় হয়েছিলাম। এখন পোস্টার লাগাই। শেয়ারবাজারের শেষ স্টেজ!”
লতিফ হাসলেন না। গম্ভীরভাবে বললেন:
— “চাচা, সময় বদলায়। আমি কিন্তু হিসেব করে ঢুকছি!”
বাসে করে মোহাম্মদপুর যাওয়ার পথে গুগলে খুঁজে খুঁজে শিখতে লাগলেন: “আইপিও মানে কী”, “পিই রেশিও কী”, “নতুন বিনিয়োগকারী কোথা থেকে শুরু করবে”।
মনে মনে ভাবলেন, “এইসব আগে পড়লে এতদিনে বড়লোক হয়ে যেতাম।”
ব্রোকার হাউজে ঢুকতেই এক স্মার্ট তরুণ বলল:
— “স্যার, নতুন বিও করবেন?”
— “হ্যাঁ ভাই, আমি বিনিয়োগ করতে চাই।”
— “কত টাকা ইনভেস্ট করবেন?”
— “পঁচিশ হাজার।”
তরুণ হেসে বলল:
— “স্যার, আপনি তো মার্কেটটাই ডুবিয়ে দিবেন!”
লতিফ ঠোঁট কামড়ে বললেন:
— “ডোবার আগে তো সাঁতার শিখতে হয় না ভাই? আমি শিখছি।”
তিন ঘণ্টা ধরে ফরম পূরণ, অ্যাকাউন্ট নম্বর, সিম যুক্ত করা, ছবি তোলা, রেফারেন্স ইত্যাদি শেষ করে লতিফ যখন বেরোলেন, তখন তাঁর হাতে একটি ছোট রসিদ,
মুখে বিজয়ের হাসি। মনে মনে বললেন:
— “আজ থেকে আমি শেয়ারবাজারের লোক!”
বাসায় ফিরে স্ত্রীর সামনে রসিদটি ধরে বললেন:
— “দেখো, তোমার স্বামী এখন ইনভেস্টর!”
স্ত্রী কৌতূহল নিয়ে বললেন:
— “তাহলে এবার কি নতুন শাড়ি আসবে?”
লতিফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন:
— “শাড়ির বদলে হয়তো আসবে সার্কিট ব্রেকার!”
রাতে বন্ধু কবির ফোন দিল:
— “লতিফ, শুনছি শেয়ারবাজারে ঢুকছিস?”
— “হ্যাঁ কবির ভাই, আগামী সপ্তাহেই লাভ শুরু!”
— “ভাইরে, লাভ চাইলেই লাভ হয় না। শেয়ারবাজার প্রেমিকার মতো—বুঝে চলতে হয়, না হলে ব্রেকআপ!”
লতিফ ফোন রেখে ইউটিউবে ভিডিও খুঁজলেন: “শেয়ারবাজারে দ্রুত লাভ করার উপায়”, “যে ৫টি স্টক এখনই কিনতে হবে”, “শতভাগ লাভ, গ্যারান্টি!”
ফেসবুকে ঢুকে “বাংলাদেশ স্টক এক্সচেঞ্জ ইনভেস্টরস” নামের কয়েকটি গ্রুপে জয়েন করলেন।
একটি পোস্টে কেউ লিখেছে:
— “ফিনিক্স ফাইন্যান্স নিচে নামছে। এখনই সময় কিনে রাখার।”
লতিফ ভাবলেন, “এই পোস্টে লাভের গন্ধ আছে।”
পরদিনই তিনি ৫০০০ টাকার ফিনিক্স কিনলেন।
তৃতীয় দিনে ৩% লাভ দেখে স্ত্রীকে বললেন:
— “এই দেখো! টাকা আসছে!”
স্ত্রী অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে বললেন:
— “বাঁচোয়া একদিনের। সাবধানে থেকো।”
কিন্তু লতিফ তখন প্রেমেই হাবুডুবু। সকালে শেয়ার দেখেন, দুপুরে শেয়ার পড়েন, রাতে শেয়ারের স্বপ্ন দেখেন। বাজারে গিয়ে ডিম কেনেন না—কারণ সেই টাকায়
আরেকটা স্টক কেনা যাবে।
একদিন কবির বলল:
— “লতিফ, মিউচুয়াল ফান্ড ধরছিস?”
— “না ভাই।”
— “বুঝি নাই। ওটা হলো ‘বিবেকের বীমা’। হঠাৎ হোঁচট খেলেও একটু সান্ত্বনা দেয়।”
দিন যায়, রাত যায়। বাজার ওঠে, নামে।
লতিফ প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙার আগেই ডিএসই অ্যাপ খুলে দেখে—‘লাল’ না ‘সবুজ’?
একদিন বাজারের গ্রাফ দেখে স্ত্রী বললেন:
— “এই যে, এটা কি হার্টবিট?”
লতিফ বললেন:
— “না, এটা আমার ভাগ্যের ইসিজি।”
এর মধ্যে কয়েকটি শেয়ার হঠাৎ করে পড়ে গেল। লতিফ কাঁপা গলায় কবিরকে ফোন দিলেন:
— “ভাই, বাজারে কী হলো?”
— “এটা শেয়ারবাজার। এখানে প্রত্যেক ইনভেস্টর একদিন না একদিন কাঁদে।”
তবে লতিফ সাহেব হাল ছাড়ার মানুষ নন।
তিনি ভাবলেন, “নতুন স্ট্র্যাটেজি দরকার। এবার থেকে ইন্ট্রাডে করব।”
বিকেলে আরেকজন গ্রুপমেট লিখল:
— “একদিনে ৮% লাভ করলাম ব্রাক ব্যাংকে। সবাই চোখ রাখুন!”
লতিফ পরদিনই ঢুকে গেলেন ব্রাকে।
কিন্তু যা হওয়ার তাই হলো—বাজার নামল, শেয়ার ডুবল।
লতিফ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন:
— “শাড়ির বদলে এবার মনে হয় জামাকাপড় বন্ধক রাখতে হবে।”
স্ত্রী শান্তভাবে বললেন:
— “কোন প্রেমেই শেষ পর্যন্ত লাভ নেই, তোর শেয়ার প্রেমও তার ব্যতিক্রম না।”
কিছুদিন পর এক সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে লতিফ ভাবছেন—কী ভুল করলেন?
শেয়ারে এত রিস্ক কেন?
সামনের মাঠে কিছু ছেলেপেলে ক্রিকেট খেলছে। তাদের গালির শব্দে হুঁশ ফিরল লতিফের।
হঠাৎ করেই তিনি হেসে উঠলেন।
“এই বাজারে যারা খেলে, তারাও তো একেকজন ব্যাটসম্যান। কেউ ছক্কা মারে, কেউ বোল্ড হয়।”
নিজেই নিজেকে বললেন:
— “আমি এখনো আউট হইনি।”
এরপর থেকে লতিফ শেখা শুরু করলেন—বাজার বিশ্লেষণ, সংবাদ, ফান্ডামেন্টাল বিশ্লেষণ।
একদিন কবির বলল:
— “তুই পাল্টে গেছিস লতিফ! এখনকার কথায় বুদ্ধির ছাপ আছে।”
লতিফ বললেন:
— “প্রেম প্রথমে বোকার মতোই শুরু হয় ভাই, পরে মানুষ সাবধান হয়। শেয়ারবাজারও তাই।”
বছরখানেক পর, ঈদের আগে একদিন স্ত্রী বললেন:
— “এই, আজ কি বাজার ভালো গেছে?”
— “হ্যাঁ, আজ লাভ হয়েছে।”
— “তাহলে একটা শাড়ি কিনে দিবা তো?”
লতিফ হেসে বললেন:
— “তোর জন্য তো সবই দিব, তুই তো আমার রিয়েল ডিভিডেন্ড!”
গল্পটা এখানেই শেষ নয়।
লতিফ এখন পাড়ার ছেলেদের শেয়ার শেখান।
ফেসবুকে “ভবিষ্যতের বিনিয়োগকারী” নামে একটি পেজ চালান।
শেয়ারবাজারে খুব বেশি টাকা না উঠলেও জীবনকে দিয়েছেন এক নতুন অর্থ।
আর বাজার?
সেই তো এখনো ডাকে—
“আয়রে লতিফ, আসল খেলা এখনো শেষ হয়নি!”