img

বিনিয়োগকারী লতিফ সাহেব!

প্রকাশিত :  ০৪:৪৯, ১৮ মে ২০২৫

বিনিয়োগকারী লতিফ সাহেব!

রেজুয়ান আহম্মেদ 

সকাল ১০টা।

ঢাকার পূর্ব রামপুরার পুরনো এক পাঁচতলা বাড়ির ছোট্ট ফ্ল্যাটে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে জেল দিচ্ছেন কাজী লতিফ সাহেব।

আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে একবার হেসে নিলেন, আবার ভ্রু কুঁচকে নিজের চেহারায় খুঁত খুঁজে দেখলেন। পেছন থেকে স্ত্রীর গলা এল:

— “এই! আজ আবার কোথায় যাবে? চাকরি তো নেই!”

লতিফ গম্ভীরভাবে জবাব দিলেন:

— “চাকরি নেই ঠিক আছে, কিন্তু শেয়ারবাজার তো আছে! আজ বিও অ্যাকাউন্ট খুলতে যাচ্ছি।”

স্ত্রী চোখ বড় করে বললেন:

— “বিও মানে কী?”

— “বউয়ের ঈদের অগ্রিম!” — লতিফ গম্ভীর গলায় রসিকতা করলেন।

স্ত্রী কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “এই বয়সেও ঠাট্টা করাটা ছাড়েনি।”

জুতা পরে গেট দিয়ে বের হতেই নিচতলার রহিম চাচা ধোঁয়াটে গলায় ডাক দিলেন:

— “ওই লতিফ! কোথায় যাচ্ছিস?”

— “চাচা, আমি আজ থেকে বিনিয়োগকারী!”

রহিম চাচা সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হেসে বললেন:

— “জানি, জানি। আমিও একসময় হয়েছিলাম। এখন পোস্টার লাগাই। শেয়ারবাজারের শেষ স্টেজ!”

লতিফ হাসলেন না। গম্ভীরভাবে বললেন:

— “চাচা, সময় বদলায়। আমি কিন্তু হিসেব করে ঢুকছি!”

বাসে করে মোহাম্মদপুর যাওয়ার পথে গুগলে খুঁজে খুঁজে শিখতে লাগলেন: “আইপিও মানে কী”, “পিই রেশিও কী”, “নতুন বিনিয়োগকারী কোথা থেকে শুরু করবে”।

মনে মনে ভাবলেন, “এইসব আগে পড়লে এতদিনে বড়লোক হয়ে যেতাম।”

ব্রোকার হাউজে ঢুকতেই এক স্মার্ট তরুণ বলল:

— “স্যার, নতুন বিও করবেন?”

— “হ্যাঁ ভাই, আমি বিনিয়োগ করতে চাই।”

— “কত টাকা ইনভেস্ট করবেন?”

— “পঁচিশ হাজার।”

তরুণ হেসে বলল:

— “স্যার, আপনি তো মার্কেটটাই ডুবিয়ে দিবেন!”

লতিফ ঠোঁট কামড়ে বললেন:

— “ডোবার আগে তো সাঁতার শিখতে হয় না ভাই? আমি শিখছি।”

তিন ঘণ্টা ধরে ফরম পূরণ, অ্যাকাউন্ট নম্বর, সিম যুক্ত করা, ছবি তোলা, রেফারেন্স ইত্যাদি শেষ করে লতিফ যখন বেরোলেন, তখন তাঁর হাতে একটি ছোট রসিদ,

মুখে বিজয়ের হাসি। মনে মনে বললেন:

— “আজ থেকে আমি শেয়ারবাজারের লোক!”

বাসায় ফিরে স্ত্রীর সামনে রসিদটি ধরে বললেন:

— “দেখো, তোমার স্বামী এখন ইনভেস্টর!”

স্ত্রী কৌতূহল নিয়ে বললেন:

— “তাহলে এবার কি নতুন শাড়ি আসবে?”

লতিফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন:

— “শাড়ির বদলে হয়তো আসবে সার্কিট ব্রেকার!”

রাতে বন্ধু কবির ফোন দিল:

— “লতিফ, শুনছি শেয়ারবাজারে ঢুকছিস?”

— “হ্যাঁ কবির ভাই, আগামী সপ্তাহেই লাভ শুরু!”

— “ভাইরে, লাভ চাইলেই লাভ হয় না। শেয়ারবাজার প্রেমিকার মতো—বুঝে চলতে হয়, না হলে ব্রেকআপ!”

লতিফ ফোন রেখে ইউটিউবে ভিডিও খুঁজলেন: “শেয়ারবাজারে দ্রুত লাভ করার উপায়”, “যে ৫টি স্টক এখনই কিনতে হবে”, “শতভাগ লাভ, গ্যারান্টি!”

ফেসবুকে ঢুকে “বাংলাদেশ স্টক এক্সচেঞ্জ ইনভেস্টরস” নামের কয়েকটি গ্রুপে জয়েন করলেন।

একটি পোস্টে কেউ লিখেছে:

— “ফিনিক্স ফাইন্যান্স নিচে নামছে। এখনই সময় কিনে রাখার।”

লতিফ ভাবলেন, “এই পোস্টে লাভের গন্ধ আছে।”

পরদিনই তিনি ৫০০০ টাকার ফিনিক্স কিনলেন।

তৃতীয় দিনে ৩% লাভ দেখে স্ত্রীকে বললেন:

— “এই দেখো! টাকা আসছে!”

স্ত্রী অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে বললেন:

— “বাঁচোয়া একদিনের। সাবধানে থেকো।”

কিন্তু লতিফ তখন প্রেমেই হাবুডুবু। সকালে শেয়ার দেখেন, দুপুরে শেয়ার পড়েন, রাতে শেয়ারের স্বপ্ন দেখেন। বাজারে গিয়ে ডিম কেনেন না—কারণ সেই টাকায়

আরেকটা স্টক কেনা যাবে।

একদিন কবির বলল:

— “লতিফ, মিউচুয়াল ফান্ড ধরছিস?”

— “না ভাই।”

— “বুঝি নাই। ওটা হলো ‘বিবেকের বীমা’। হঠাৎ হোঁচট খেলেও একটু সান্ত্বনা দেয়।”

দিন যায়, রাত যায়। বাজার ওঠে, নামে।

লতিফ প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙার আগেই ডিএসই অ্যাপ খুলে দেখে—‘লাল’ না ‘সবুজ’?

একদিন বাজারের গ্রাফ দেখে স্ত্রী বললেন:

— “এই যে, এটা কি হার্টবিট?”

লতিফ বললেন:

— “না, এটা আমার ভাগ্যের ইসিজি।”

এর মধ্যে কয়েকটি শেয়ার হঠাৎ করে পড়ে গেল। লতিফ কাঁপা গলায় কবিরকে ফোন দিলেন:

— “ভাই, বাজারে কী হলো?”

— “এটা শেয়ারবাজার। এখানে প্রত্যেক ইনভেস্টর একদিন না একদিন কাঁদে।”

তবে লতিফ সাহেব হাল ছাড়ার মানুষ নন।

তিনি ভাবলেন, “নতুন স্ট্র্যাটেজি দরকার। এবার থেকে ইন্ট্রাডে করব।”

বিকেলে আরেকজন গ্রুপমেট লিখল:

— “একদিনে ৮% লাভ করলাম ব্রাক ব্যাংকে। সবাই চোখ রাখুন!”

লতিফ পরদিনই ঢুকে গেলেন ব্রাকে।

কিন্তু যা হওয়ার তাই হলো—বাজার নামল, শেয়ার ডুবল।

লতিফ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন:

— “শাড়ির বদলে এবার মনে হয় জামাকাপড় বন্ধক রাখতে হবে।”

স্ত্রী শান্তভাবে বললেন:

— “কোন প্রেমেই শেষ পর্যন্ত লাভ নেই, তোর শেয়ার প্রেমও তার ব্যতিক্রম না।”

কিছুদিন পর এক সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে লতিফ ভাবছেন—কী ভুল করলেন?

শেয়ারে এত রিস্ক কেন?

সামনের মাঠে কিছু ছেলেপেলে ক্রিকেট খেলছে। তাদের গালির শব্দে হুঁশ ফিরল লতিফের।

হঠাৎ করেই তিনি হেসে উঠলেন।

“এই বাজারে যারা খেলে, তারাও তো একেকজন ব্যাটসম্যান। কেউ ছক্কা মারে, কেউ বোল্ড হয়।”

নিজেই নিজেকে বললেন:

— “আমি এখনো আউট হইনি।”

এরপর থেকে লতিফ শেখা শুরু করলেন—বাজার বিশ্লেষণ, সংবাদ, ফান্ডামেন্টাল বিশ্লেষণ।

একদিন কবির বলল:

— “তুই পাল্টে গেছিস লতিফ! এখনকার কথায় বুদ্ধির ছাপ আছে।”

লতিফ বললেন:

— “প্রেম প্রথমে বোকার মতোই শুরু হয় ভাই, পরে মানুষ সাবধান হয়। শেয়ারবাজারও তাই।”

বছরখানেক পর, ঈদের আগে একদিন স্ত্রী বললেন:

— “এই, আজ কি বাজার ভালো গেছে?”

— “হ্যাঁ, আজ লাভ হয়েছে।”

— “তাহলে একটা শাড়ি কিনে দিবা তো?”

লতিফ হেসে বললেন:

— “তোর জন্য তো সবই দিব, তুই তো আমার রিয়েল ডিভিডেন্ড!”

গল্পটা এখানেই শেষ নয়।

লতিফ এখন পাড়ার ছেলেদের শেয়ার শেখান।

ফেসবুকে “ভবিষ্যতের বিনিয়োগকারী” নামে একটি পেজ চালান।

শেয়ারবাজারে খুব বেশি টাকা না উঠলেও জীবনকে দিয়েছেন এক নতুন অর্থ।

আর বাজার?

সেই তো এখনো ডাকে—

“আয়রে লতিফ, আসল খেলা এখনো শেষ হয়নি!”

img

ঈদ যখন কাঁদে অভাবের কাছে: উৎসবের আলো আর অন্ধকারের গল্প

প্রকাশিত :  ০৫:৩০, ০৮ জুন ২০২৫

ঈদের নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোট ছোট শিশুর হাসিমাখা মুখ, নতুন জামার রঙ, বাজারের কোলাহল, সুগন্ধে ভরা রান্নাঘর আর পরিবারজুড়ে ভালোবাসার উষ্ণতা। মনে হয়, এ যেন এক মিলনের উৎসব, ভালোবাসার উৎসব—মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোর এক মহা-উপলক্ষ।

কিন্তু একটু ভাবুন—এই উৎসব কি সবার জন্য একই রকম আনন্দ বয়ে আনে?

ঈদের পেছনের সেই নিঃশব্দ কান্না

আমরা অনেকেই ঈদের আগে বাজারে যাই, জামাকাপড় কিনি, খাবারদাবারে ঘর সাজাই, ছবি তুলে পোস্ট দিই—সবই স্বাভাবিক আনন্দের অংশ। কিন্তু আমাদের আশপাশেই এমন অনেক পরিবার আছে, যারা ঈদের আগের রাতে জানে না, পরদিন সকালে তাদের শিশুটি আদৌ কিছু খেতে পাবে কি না।

তারা ফেসবুকে অন্যদের ছবিতে ঈদের রঙ দেখে, ছেলেমেয়েদের হাসিমুখ দেখে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঈদের আমেজটা গায়ে মাখার চেষ্টা করে—কিন্তু মনে মনে ভেঙে পড়ে।

একজন মা যখন সন্তানের নতুন জামার আবদার শুনে চুপ করে থাকেন, চোখের জল আড়াল করতে রান্নাঘরে চলে যান—তখন ঈদের আনন্দ তার কাছে হয়ে ওঠে এক অদৃশ্য বোঝা।

তিনি বলেন, “কাল পাবে বাবা, কাল পাবে”—এই ‘কাল’ যে কবে আসবে, তিনি নিজেও জানেন না। তবু সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করাটাই যেন তার ঈদের একমাত্র প্রস্তুতি।

রিকশাচালক বাবার সন্ধ্যা

রিকশা চালানো মানুষটি ঈদের দিনেও রাস্তায় থাকেন—কারণ এই দিনটিতে একটু বেশি উপার্জনের সম্ভাবনা থাকে। সন্ধ্যায় তিনি বাড়ি ফেরেন ক্লান্ত শরীরে, পকেট ফাঁকা, মুখে নিঃশব্দ বিষণ্ণতা।

বাচ্চা জিজ্ঞাসা করে, “বাবা, আমার জামা কই?”

তিনি মাথা নিচু করে বলেন, “এইবার না, পরেরবার।”

এই কথাটি বলার সময় তার বুকের ভেতর যে ঝড় বয়ে যায়—তা কেউ দেখে না, কেউ বোঝেও না।

শিশুর চোখে ঈদের রংহীনতা

ঈদ তো শিশুদের আনন্দের দিন—এমনটাই শুনে বড় হয় তারা। কিন্তু যেসব শিশু নতুন জামা পায় না, খেলনা পায় না, পেট ভরে খেতে পায় না—তারা কেমন করে ঈদ উদযাপন করে?

তারা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঈদ দেখে। এক ধরনের ঈর্ষা, অপমান আর অক্ষমতা মিশে তৈরি হয় তাদের জীবনের প্রথম ঈদের শিক্ষা—“ঈদ সবার জন্য নয়।”

এই শিক্ষা একটি শিশুকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তাদের হৃদয়ে জন্ম নেয় অভিমান, সমাজব্যবস্থার প্রতি রাগ, ঈদের প্রতি ঘৃণা।

ঈদের আসল পাঠ—কোথায় হারিয়ে গেল?

ঈদের মূল শিক্ষা ছিল সহমর্মিতা, সমতা ও ভালোবাসা। কিন্তু আজকাল এই শিক্ষা অনেক সময় ফেসবুক পোস্ট আর ছবি তোলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। যাকাত-সদকা অনেকটাই লোক দেখানো কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে।

আসলে, একটি দরিদ্র শিশুকে জামা কিনে দেওয়া কোনো দয়া নয়—এটা তার ন্যায্য প্রাপ্য। একজন রিকশাচালককে ঈদের দিনে এক প্যাকেট বিরিয়ানি দেওয়া সহানুভূতি নয়, বরং ন্যূনতম মানবিক দায়িত্ব পালন।

হাজার টাকায় ফিরতে পারে একটি ঈদ

আপনার ঈদের খরচ যদি পঞ্চাশ হাজার টাকা হয়, তার মধ্যে মাত্র এক হাজার টাকা ব্যয় করলেই একটি পরিবারের মুখে ঈদের হাসি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

একটা জামা, একজোড়া জুতো, এক প্লেট বিরিয়ানি—এগুলো কোনো বিলাসিতা নয়। সামান্য সদিচ্ছা থাকলেই এই ছোট ছোট উপহারগুলো বহু মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারে।

ঈদ সবার হোক—তবেই পূর্ণতা

আমরা চাই না সবাই সমাজবিপ্লবী হোক। শুধু চাই—আপনার পাশের দরিদ্র শিশুটির জন্য একটি জামা কিনে দিন। রাস্তার সেই বৃদ্ধ মায়ের হাতে এক প্যাকেট মিষ্টি তুলে দিন।

এই ছোট ছোট ভালোবাসার কাজগুলোই ঈদকে সত্যিকার অর্থে সবার করে তোলে।

রাষ্ট্র কি পারত না পাশে দাঁড়াতে?

একটি রাষ্ট্র চাইলে ঈদের দিনে কোনো পরিবার না খেয়ে থাকবে না—এটা নিশ্চিত করা কঠিন কিছু নয়। ঈদের সময় একটি কেন্দ্রীয় কর্মসূচি চালু করে দরিদ্র পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়া যেত—এটা হতে পারত এক নতুন দৃষ্টান্ত।

সরকারি খাদ্য সহায়তা, জামা বিতরণ, শিশুবান্ধব উপহার কার্যক্রম—এসব শুরু হলে ঈদ আর কারো জন্য অন্ধকার হয়ে থাকত না।

ঈদ হোক ভালোবাসার নাম

আমরা যতই বলি ঈদ মানে আনন্দ, ততদিন তা খালি বুলি হিসেবেই থাকবে—যতদিন না আমরা সেই আনন্দ সবার মাঝে ভাগ করে নিতে শিখি।

এই ঈদে আসুন আমরা কিছু সিদ্ধান্ত নিই—একটি মুখে হাসি ফোটাব, একটি পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে বলব: “তোমরা একা নও।”

এই ছোট ছোট ভালোবাসার স্পর্শগুলোই ঈদকে ঈদ বানায়। নামাজ শেষে কোলাকুলি করার আগে যদি একটু ভাবি—আমার চারপাশে কেউ কি আজও না খেয়ে আছে? কারো সন্তানের মুখ কি আজও শুকনো?

কারণ ঈদ শুধু নামাজের উৎসব নয়। ঈদ হলো হৃদয়ের উৎসব—যেখানে সকল শ্রেণি, সকল মানুষ একসাথে বলে, “আমরা একসাথে।”

ঈদ হোক সেই ভালোবাসার গল্প—যা শুরু হয় একজন মানুষের হাসি দিয়ে, আর ছড়িয়ে পড়ে হাজারো হৃদয়ে।