img

বংশের পরিচয়!

প্রকাশিত :  ১২:০০, ১২ মে ২০২৫

বংশের পরিচয়!

রেজুয়ান আহম্মেদ

আষাঢ়ের এক ভিজে বিকেল। আকাশের গর্জন থেমে গেছে বটে, কিন্তু বাতাসে এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে কাঁচা মাটির ঘ্রাণ। উঠোনে জমে আছে নিঃশব্দতা। দূরের বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা গান—যেন সময় থেমে গেছে, কিংবা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।  

রতন মাস্টার বসে আছেন পুরোনো আমগাছটার ছায়ায়। হাতে নাইলনের সুতো, বাঁধছেন মাছ ধরার জাল। দেখে মনে হয়, এই জালের ফাঁকেই তিনি বুনে চলেছেন জীবনের গল্প—ভাঙা স্বপ্ন, না বলা কথা, হারিয়ে যাওয়া সময় আর কিছু গোপন কষ্ট।  

ঠিক এমন সময়, গ্রামের পেছনের কাদা-ঢালা পথ বেয়ে এসে দাঁড়াল সজল। আধময়লা ছেঁড়া জিন্স, হাঁটুর কাছ থেকে ঝুলে থাকা ইয়ারফোনের তার, আর চোখজোড়া যেন কিছু হারানোর গ্লানিতে ঘোলাটে।  

সে আমগাছের গুঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে, একটু নিচু গলায় বলল,  

— “মাস্টার চাচা... শহরের বন্ধুরা মজা করে বলে ‘রংপুরের মফিজ’। তাদের পূর্বপুরুষরা কেউ জমিদার, কেউ ব্যারিস্টার। আর আমার শিকড় তো চাষার ঘরে...”

রতন মাস্টার চশমাটা একটু উঁচু করে তাকালেন। চোখের কোণায় বয়সের ভাঁজ হলেও, দৃষ্টিতে ছিল একরাশ কোমলতা। ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে বললেন,  

— “চা খাবি সজল? পাতলা লেবু চা, না কি গাঢ় দুধ চা?”

সজলের গলা কেঁপে উঠল, সে ফিসফিস করে বলল,  

— “যে চায়ের কাপে বংশের গরিমার সুবাস থাকে, সেই চা চাই…”

রতন মাস্টার জালটা থামিয়ে পাশে রাখলেন। একটু নীরব হয়ে বললেন,  

— “আয়, আজ তোকে একটা গল্প শোনাই। এক চাষার গল্প, যার হাতে ছিল না জমিদারি দলিল, কিন্তু মুঠোয় ছিল বিশুদ্ধ স্বপ্ন আর সৎ ইচ্ছে।” 

এ গল্প আসলে তাঁর নিজের—রতন মাস্টারের। মাটির ঘরে জন্ম তাঁর, টিনের চাল ভেদ করে বৃষ্টির পানি যে ঘরে প্রতিরাতে বালিশ ভিজিয়ে দিত। বাবা শিবু মণ্ডল, গরিব কৃষক; আধ বিঘা জমি, আর সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি। মা পদ্মা দেবী রোজ ভোরে বলে উঠতেন,  

— “মানুষের উপকার করিস রতন। মানুষের পাশে দাঁড়ানোই তো সবচেয়ে বড় ধর্ম।”

রতনের বয়স তখন বারো, সেদিনই তাঁর বাবা না-ফেরার দেশে চলে যান। সেই ছোট্ট কাঁধে সংসারের ভার। গরুর পিঠে চড়ে দুধ বিক্রি করতেন সকালে, আর রাতে স্কুলের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে পড়তেন। পাড়ার ছেলেরা হাসত, বলত—“দুধওয়ালা পণ্ডিত!” 

রতন হেসে বলত, “এক গরু দিচ্ছে শরীরের শক্তি, আরেকটা মনকে দিচ্ছে জ্ঞানের আলো—দুটোই দরকার মানুষ বাঁচাতে।”

একবার পরীক্ষার হলে সবাই নকল করছে। রতন সাদা খাতা জমা দেয়। শিক্ষক রেগে গিয়ে বললেন, “তুই ফেল করলি!”  

রতনের জবাব ছিল—“খাতায় ফেল, কিন্তু বিবেকের খাতায় তো একশো!” 

দিন গড়াতে গড়াতে তাঁর পাঠশালায় ভিড় বাড়ে। গরিব, অনাথ, পথশিশু—সবাই তাঁর ছাত্র। একদিন গ্রামের চেয়ারম্যান ঠাট্টা করে বললেন, “চাষার ঘরে জন্ম নিয়ে এত পড়া শিখে কী করবি?”

রতনের উত্তর ছিল, “জন্ম তো আমার হাতে ছিল না। কিন্তু আমি মানুষের মতো মানুষ হবো, এটা আমার সিদ্ধান্ত!”

মুসলিম-হিন্দু, জাত-পাত তাঁর কাছে কিছুই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ঈদের সকালে গোপাল কাকার বাড়ি গিয়ে হাতে মিষ্টি তুলে দিতেন, আবার দুর্গাপূজায় মুসলিম ছেলেদের সাথে মিলে মণ্ডপে আলপনা আঁকতেন।  

একবার মন্দিরে আগুন ধরলে, তিনি দৌড়ে ঢুকে যান আগুনে। হাত পুড়ে গেলেও মুখে শুধু বললেন, “মানুষের ধর্মে আগুন লাগলে, পানি ঢালাটাই তো আমার কাজ।”

একদিন এক রাজনীতিবিদ এলেন ভোট চাইতে। রতন জিজ্ঞেস করলেন, “গ্রামের সেই অন্ধ মা যার চোখে অস্ত্রোপচারের টাকা নেই, আপনি কি তাঁর জন্য কিছু করেছেন?”

তিন দিন পর রাজনীতিবিদ এসে প্রণাম করে বললেন, “আপনি শিখিয়ে দিলেন, রাজনীতি মানে পকেট ভরা না, হৃদয় ভরা!”

সজল নীরবে শুনছিল। সেদিন থেকে তার ভেতরটা বদলে গেল। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেও আর শহরের চাকরির পেছনে ছুটল না। গড়ে তুলল ‘মাটির পাঠশালা’। সেখানে এখন রাস্তার শিশুরা শেখে অক্ষর চিনতে, আর স্বপ্ন দেখতে। রতনের কথা সে লিখে রেখেছে ডায়েরির প্রথম পাতায়—  

“বংশের পরিচয় রক্তে নয়, কর্মে।” 

পঁচিশ বছর কেটে গেছে...  

গ্রামের মেলায় মাইক হাতে সজল দাঁড়িয়ে বলছে,  

— “আমার পেছনে নেই জমিদার বংশ, নেই ইতিহাসের ভারি গরিমা। আছে এক মাটির মানুষ, যিনি আমাকে শিখিয়েছেন—মানুষের পরিচয় তার আদর্শে, তার কাজে।”

মাঠজুড়ে করতালির শব্দ। ছাপড়া ঘর থেকে হেঁটে এলেন এক বৃদ্ধ—রতন মাস্টার। পায়ের জুতা নেই, কিন্তু চোখে জল। গ্রামের মানুষ চিৎকার করে উঠল,  

— “এই তো আমাদের গর্ব, আমাদের বংশ!”  

রতন মাস্টার চোখ মুছে শুধু বললেন,  

— “বংশ মানে জন্ম নয়। বংশ মানে নদীর মতো হওয়া—নিজের পথ নিজেই বানিয়ে, সবার পিপাসা মেটানো।”

তোমার জন্ম হয়তো মাটির ঘরে, কিন্তু কর্ম যদি হয় আকাশ ছোঁয়া, তবে সেই কর্মই তোমার শ্রেষ্ঠ পরিচয়। কারণ, সত্যিকারের বংশ পরিচয় রক্তে নয়—আদর্শে।

img

বাংলাদেশের ইতিহাসে রাণী ভবানী ও নাটোর রাজবাড়ী: অর্ধবঙ্গেশ্বরীর গৌরবগাথা

প্রকাশিত :  ০৯:২৫, ০৪ নভেম্বর ২০২৫

সংগ্রাম দত্ত

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত নাটোর জেলা একসময় ছিল রাজকীয় ঐশ্বর্যের কেন্দ্রস্থল। এই জেলার সদর উপজেলায় অবস্থিত বিখ্যাত রাণী ভবানী রাজবাড়ী, বাংলার ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়ের সাক্ষী। জমিদারি প্রথার উত্থান-পতনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই রাজবংশের নাম, যেখান থেকে এক নারী – রাণী ভবানী – সমগ্র বাংলার “অর্ধবঙ্গেশ্বরী” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

নাটোর রাজবংশের সূচনা: অষ্টাদশ শতকের শুরুতে নাটোর রাজবংশের যাত্রা শুরু হয়। ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে পরগণা বানগাছির জমিদার গণেশ রায় ও ভবানীচরণ চৌধুরী রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হয়ে চাকরিচ্যুত হন। তাঁদের জমিদারি কেড়ে নিয়ে দেওয়ান রঘুনন্দন তাঁর ভাই রামজীবনের নামে বন্দোবস্ত নেন। এই রামজীবনই ছিলেন নাটোর রাজবংশের প্রথম রাজা।

রাজা রামজীবন ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে) জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৭৩৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর নিজ সন্তান না থাকায় জীবদ্দশায় এক পুত্র দত্তক নেন—রামকান্ত।

রাণী ভবানীর আগমন:১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামজীবনের দত্তকপুত্র রামকান্তের সঙ্গে বিয়ে হয় রাণী ভবানীর। রাজা রামকান্তের মৃত্যুর পর ১৭৪৮ সালে নবাব আলীবর্দী খাঁ রাণী ভবানীর হাতে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন।

রাণী ভবানীর জন্ম ১৭২৩ সালে বগুড়া জেলার আদমদিঘি থানার ছাতিয়ানগ্রাম গ্রামে। তাঁর পিতা আত্মারাম চৌধুরী ও মাতা জয়দুর্গা দেবী। অল্প বয়সেই তিনি রাজবংশের বধূ হিসেবে নাটোরে আসেন।

অর্ধবঙ্গেশ্বরী রাণী ভবানী: রাণী ভবানীর রাজত্বকালে নাটোর রাজবাড়ির প্রভাব বিস্তৃত হয় এক বিশাল অঞ্চলে। তাঁর জমিদারি ছড়িয়ে ছিল বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও মালদহ পর্যন্ত।

ইংরেজ লেখক হলওয়েলের হিসাবে, তাঁর জমিদারি থেকে বার্ষিক রাজস্ব আয় হতো প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা, যা তৎকালীন সময়ের এক বিরাট অঙ্ক। দক্ষ প্রশাসন, প্রজাহিতৈষী মনোভাব ও দানশীলতার কারণে প্রজারা তাঁকে ভালোবেসে “অর্ধবঙ্গেশ্বরী” নামে অভিহিত করেছিল।

প্রজাদের কল্যাণে দানশীল রাণী: রাণী ভবানীর জীবনযাপন ছিল অনাড়ম্বর, কিন্তু সমাজসেবায় তাঁর দৃষ্টান্ত অনন্য। তিনি শত শত মন্দির, অতিথিশালা ও রাস্তা নির্মাণ করেন। প্রজাদের জন্য পুকুর খনন করে পানীয় জলের ব্যবস্থা করেন এবং শিক্ষা বিস্তারে অনুদান প্রদান করেন।

১৭৫৩ সালে তিনি কাশীতে (বর্তমান বারাণসী) ভবানীশ্বর শিব ও দুর্গাবাড়ী, দুর্গাকুণ্ড ও কুরুক্ষেত্রতলা নামক পবিত্র স্থান নির্মাণ করেন। তাঁর উদ্যোগেই হাওড়া থেকে কাশী পর্যন্ত দীর্ঘ সড়কপথ নির্মিত হয়, যা তখন পরিচিত ছিল “রাণী ভবানী রোড” বা “বেনারস রোড” নামে।

ধর্মীয় অবদান ও দেবোত্তর সম্পত্তি: বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার ভবানীপুর শক্তিপীঠ উন্নয়নে রাণী ভবানীর অবদান আজও স্মরণীয়। কথিত আছে, তিনি প্রতি বছর দু’বার হাতি বহর নিয়ে ভবানীপুরে যেতেন।

পাকিস্তান আমলে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও রাণী ভবানী স্টেটের উত্তরাধিকারীরা ২৬২ একর জমি দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে ভবানীপুর শক্তিপীঠের নামে দানপত্রে নিবন্ধন করে দেন। বর্তমানে ঐ জমির একটি বড় অংশ প্রভাবশালী মহলের দখলে চলে গেছে, যার পুনরুদ্ধারে আদালতে একাধিক মামলা চলছে।

তারাপীঠে অবদান ও বামাক্ষ্যাপার নিয়োগ: বীরভূম জেলার বিখ্যাত তারাপীঠ মন্দিরও তাঁর জমিদারির অন্তর্গত ছিল। ভগ্নপ্রায় অবস্থায় থাকা মন্দিরটি তিনি পুনর্নির্মাণ করেন এবং কিংবদন্তি সাধক বামাক্ষ্যাপাকে মন্দিরের পুরোহিত হিসেবে নিয়োগ দেন।

রাণী ভবানীর রাজবাড়ি, স্থাপত্য ও ঐতিহ্য: নাটোর রাজবাড়ি নির্মাণ শুরু হয় ১৭০৬-১৭১০ সালের মধ্যে। রাজবাড়ির আয়তন প্রায় ১২০ একর, যেখানে ছোট-বড় ৮টি ভবন, ৭টি পুকুর, এবং দুটি স্তরের বেষ্টনী প্রাচীর রয়েছে।

রাজবাড়ি বিভক্ত দুই ভাগে—বড় তরফ ও ছোট তরফ। এখানকার প্রধান মন্দিরগুলো হলো শ্যামসুন্দর মন্দির, আনন্দময়ী কালিবাড়ি ও তারকেশ্বর শিবমন্দির।

রাজবংশের রাজধানী স্থাপনের জন্য রামজীবন ভাতঝাড়ার বিল এলাকা নির্বাচন করেন, যা পরবর্তীতে “নাট্যপুর” নাম ধারণ করে “নাটোর” নামে পরিচিত হয়।

জীবনের শেষ অধ্যায়: দত্তক পুত্র রামকৃষ্ণের হাতে জমিদারি দায়িত্ব অর্পণ করে রাণী ভবানী মুর্শিদাবাদ জেলার বড়নগরে চলে আসেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ভাগীরথী নদীর তীরে তিনি নির্মাণ করেন ১০০টি শিবমন্দির, যার কিছু আজও টিকে আছে।

তাঁর মৃত্যুর পর ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁর রংপুরের জমিদারি দখল করেন। দীর্ঘ ও কর্মবহুল জীবনের পর রাণী ভবানী ১৮০২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, ৭৯ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।

বর্তমান অবস্থা: নাটোর রাজবাড়ি আজ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও পর্যটন স্থাপনা। ১৯৮৬ সাল থেকে রাজবাড়ির পুরো এলাকা জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে “রাণী ভবানী কেন্দ্রীয় উদ্যান ও যুবপার্ক” নামে পরিচালিত হচ্ছে।

রাণী ভবানী কেবল নাটোর বা রাজশাহীর ইতিহাসে নয়, সমগ্র বাংলার ইতিহাসে এক আলোকবর্তিকা—যিনি প্রমাণ করেছিলেন, নারীর নেতৃত্বও রাজনীতি ও প্রশাসনে সমান সফল হতে পারে। তাঁর স্মৃতি, দানশীলতা ও প্রজাহিতৈষী মনোভাব আজও বাংলার মাটিতে কিংবদন্তি হয়ে আছে।