বংশের পরিচয়!
রেজুয়ান আহম্মেদ
আষাঢ়ের এক ভিজে বিকেল। আকাশের গর্জন থেমে গেছে বটে, কিন্তু বাতাসে এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে কাঁচা মাটির ঘ্রাণ। উঠোনে জমে আছে নিঃশব্দতা। দূরের বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা গান—যেন সময় থেমে গেছে, কিংবা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।
রতন মাস্টার বসে আছেন পুরোনো আমগাছটার ছায়ায়। হাতে নাইলনের সুতো, বাঁধছেন মাছ ধরার জাল। দেখে মনে হয়, এই জালের ফাঁকেই তিনি বুনে চলেছেন জীবনের গল্প—ভাঙা স্বপ্ন, না বলা কথা, হারিয়ে যাওয়া সময় আর কিছু গোপন কষ্ট।
ঠিক এমন সময়, গ্রামের পেছনের কাদা-ঢালা পথ বেয়ে এসে দাঁড়াল সজল। আধময়লা ছেঁড়া জিন্স, হাঁটুর কাছ থেকে ঝুলে থাকা ইয়ারফোনের তার, আর চোখজোড়া যেন কিছু হারানোর গ্লানিতে ঘোলাটে।
সে আমগাছের গুঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে, একটু নিচু গলায় বলল,
— “মাস্টার চাচা... শহরের বন্ধুরা মজা করে বলে ‘রংপুরের মফিজ’। তাদের পূর্বপুরুষরা কেউ জমিদার, কেউ ব্যারিস্টার। আর আমার শিকড় তো চাষার ঘরে...”
রতন মাস্টার চশমাটা একটু উঁচু করে তাকালেন। চোখের কোণায় বয়সের ভাঁজ হলেও, দৃষ্টিতে ছিল একরাশ কোমলতা। ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে বললেন,
— “চা খাবি সজল? পাতলা লেবু চা, না কি গাঢ় দুধ চা?”
সজলের গলা কেঁপে উঠল, সে ফিসফিস করে বলল,
— “যে চায়ের কাপে বংশের গরিমার সুবাস থাকে, সেই চা চাই…”
রতন মাস্টার জালটা থামিয়ে পাশে রাখলেন। একটু নীরব হয়ে বললেন,
— “আয়, আজ তোকে একটা গল্প শোনাই। এক চাষার গল্প, যার হাতে ছিল না জমিদারি দলিল, কিন্তু মুঠোয় ছিল বিশুদ্ধ স্বপ্ন আর সৎ ইচ্ছে।”
এ গল্প আসলে তাঁর নিজের—রতন মাস্টারের। মাটির ঘরে জন্ম তাঁর, টিনের চাল ভেদ করে বৃষ্টির পানি যে ঘরে প্রতিরাতে বালিশ ভিজিয়ে দিত। বাবা শিবু মণ্ডল, গরিব কৃষক; আধ বিঘা জমি, আর সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি। মা পদ্মা দেবী রোজ ভোরে বলে উঠতেন,
— “মানুষের উপকার করিস রতন। মানুষের পাশে দাঁড়ানোই তো সবচেয়ে বড় ধর্ম।”
রতনের বয়স তখন বারো, সেদিনই তাঁর বাবা না-ফেরার দেশে চলে যান। সেই ছোট্ট কাঁধে সংসারের ভার। গরুর পিঠে চড়ে দুধ বিক্রি করতেন সকালে, আর রাতে স্কুলের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে পড়তেন। পাড়ার ছেলেরা হাসত, বলত—“দুধওয়ালা পণ্ডিত!”
রতন হেসে বলত, “এক গরু দিচ্ছে শরীরের শক্তি, আরেকটা মনকে দিচ্ছে জ্ঞানের আলো—দুটোই দরকার মানুষ বাঁচাতে।”
একবার পরীক্ষার হলে সবাই নকল করছে। রতন সাদা খাতা জমা দেয়। শিক্ষক রেগে গিয়ে বললেন, “তুই ফেল করলি!”
রতনের জবাব ছিল—“খাতায় ফেল, কিন্তু বিবেকের খাতায় তো একশো!”
দিন গড়াতে গড়াতে তাঁর পাঠশালায় ভিড় বাড়ে। গরিব, অনাথ, পথশিশু—সবাই তাঁর ছাত্র। একদিন গ্রামের চেয়ারম্যান ঠাট্টা করে বললেন, “চাষার ঘরে জন্ম নিয়ে এত পড়া শিখে কী করবি?”
রতনের উত্তর ছিল, “জন্ম তো আমার হাতে ছিল না। কিন্তু আমি মানুষের মতো মানুষ হবো, এটা আমার সিদ্ধান্ত!”
মুসলিম-হিন্দু, জাত-পাত তাঁর কাছে কিছুই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ঈদের সকালে গোপাল কাকার বাড়ি গিয়ে হাতে মিষ্টি তুলে দিতেন, আবার দুর্গাপূজায় মুসলিম ছেলেদের সাথে মিলে মণ্ডপে আলপনা আঁকতেন।
একবার মন্দিরে আগুন ধরলে, তিনি দৌড়ে ঢুকে যান আগুনে। হাত পুড়ে গেলেও মুখে শুধু বললেন, “মানুষের ধর্মে আগুন লাগলে, পানি ঢালাটাই তো আমার কাজ।”
একদিন এক রাজনীতিবিদ এলেন ভোট চাইতে। রতন জিজ্ঞেস করলেন, “গ্রামের সেই অন্ধ মা যার চোখে অস্ত্রোপচারের টাকা নেই, আপনি কি তাঁর জন্য কিছু করেছেন?”
তিন দিন পর রাজনীতিবিদ এসে প্রণাম করে বললেন, “আপনি শিখিয়ে দিলেন, রাজনীতি মানে পকেট ভরা না, হৃদয় ভরা!”
সজল নীরবে শুনছিল। সেদিন থেকে তার ভেতরটা বদলে গেল। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেও আর শহরের চাকরির পেছনে ছুটল না। গড়ে তুলল ‘মাটির পাঠশালা’। সেখানে এখন রাস্তার শিশুরা শেখে অক্ষর চিনতে, আর স্বপ্ন দেখতে। রতনের কথা সে লিখে রেখেছে ডায়েরির প্রথম পাতায়—
“বংশের পরিচয় রক্তে নয়, কর্মে।”
পঁচিশ বছর কেটে গেছে...
গ্রামের মেলায় মাইক হাতে সজল দাঁড়িয়ে বলছে,
— “আমার পেছনে নেই জমিদার বংশ, নেই ইতিহাসের ভারি গরিমা। আছে এক মাটির মানুষ, যিনি আমাকে শিখিয়েছেন—মানুষের পরিচয় তার আদর্শে, তার কাজে।”
মাঠজুড়ে করতালির শব্দ। ছাপড়া ঘর থেকে হেঁটে এলেন এক বৃদ্ধ—রতন মাস্টার। পায়ের জুতা নেই, কিন্তু চোখে জল। গ্রামের মানুষ চিৎকার করে উঠল,
— “এই তো আমাদের গর্ব, আমাদের বংশ!”
রতন মাস্টার চোখ মুছে শুধু বললেন,
— “বংশ মানে জন্ম নয়। বংশ মানে নদীর মতো হওয়া—নিজের পথ নিজেই বানিয়ে, সবার পিপাসা মেটানো।”
তোমার জন্ম হয়তো মাটির ঘরে, কিন্তু কর্ম যদি হয় আকাশ ছোঁয়া, তবে সেই কর্মই তোমার শ্রেষ্ঠ পরিচয়। কারণ, সত্যিকারের বংশ পরিচয় রক্তে নয়—আদর্শে।



















