
গৈলার গর্ব: শহীদ তারকেশ্বর সেনগুপ্ত ও এক বিস্মৃত বিপ্লবের ইতিহাস

সংগ্রাম দত্ত
বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা গ্রামের প্রবেশমুখে, গৈলা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক নীরব ইতিহাসের সাক্ষী—শহীদ তারকেশ্বর সেনগুপ্তের স্মৃতিস্তম্ভ।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই স্তম্ভটি দেখলেও, ক’জনই বা জানে এর পেছনের রক্তঝরা ইতিহাস? ক’জনই বা জানে গৈলার গর্ব, বিপ্লবী তারকেশ্বর সেনগুপ্তের নাম?
জন্ম ও সংগ্রামের সূচনা
১৯০৫ সালের ১৫ এপ্রিল গৈলায় জন্ম নেন তারকেশ্বর সেনগুপ্ত। কৈশোর থেকেই তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯২০-এর দশকের প্রথমভাগে সতীর্থদের নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘গৈলা সেবাশ্রম’, যা পরে ‘গৈলা শহীদ স্মৃতিসংঘ’ নামে পরিচিত হয়।
আশ্রমটির আড়ালে ছিল বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের গোপন ঘাঁটি। শিবলিঙ্গকে তাঁরা শৌর্য ও বীর্যের প্রতীক হিসেবে বেছে নেন—ধর্মাচারের আড়ালে বিপ্লবকে এগিয়ে নেবার বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল। নৈশ বিদ্যালয়, পাঠাগার, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড—সবই ছিল বিপ্লবী চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার হাতিয়ার। শুধু হিন্দু যুবক নয়, স্থানীয় মুসলিম তরুণেরাও এতে যুক্ত হন, যা প্রমাণ করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে গিয়ে কেবল স্বাধীনতার স্বপ্নেই অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
বঙ্গ থেকে ভারত: আন্দোলনের বিস্তার
গৈলার বিপ্লবীদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকেনি কেবল গ্রামে বা পূর্ববঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতবর্ষজুড়ে তাঁদের প্রভাব বিস্তার পায়। এর জেরেই ব্রিটিশ সরকার তাঁরকেশ্বরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর এর হিজলী বন্দিশিবিরে ।
শহীদের আত্মাহুতি
১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় হিজলী বন্দিশিবির থেকে সহযোদ্ধাদের নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন তারকেশ্বর সেনগুপ্ত। কিন্তু ব্রিটিশের বন্দুকের গুলিতে সেদিনই শেষ হয় তাঁর বিপ্লবী জীবনের অধ্যায়।
আজও সেই স্থান খড়্গপুরের হিজলী রেলস্টেশনের পাশে ইতিহাসের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বন্দিশিবিরের ওয়াচ টাওয়ারটি এখনও সাক্ষ্য দেয় এক রক্তাক্ত রাতের।
সেখানে খোদাই করা আছে বেদনার্ত কিন্তু গৌরবময় পঙক্তি:
“হিজলী বন্দিশিবিরে ইংরেজ শাসকের গুলিবর্ষণে দেশের মুক্তিযজ্ঞে তোমাদের শৌর্যময় আত্মাহুতি শ্রদ্ধানত অন্তরে স্মরণ করি।”
—তোমাদের গুণমুগ্ধ স্বদেশবাসী
গৈলায় নেতাজির পদচিহ্ন
অবিভক্ত ভারতবর্ষে বিপিনচন্দ্র পাল, মদন মোহন মালবীয়, স্বামী প্রণবানন্দ প্রমুখ মহাপুরুষের আগমনে গৈলা ইতিহাসে সমুজ্জ্বল। তাঁদের মধ্যে সর্বশেষে আসেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। শহীদ তারকেশ্বর সেনগুপ্তের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের জন্যই তিনি গৈলায় পা রাখেন।
আজকের প্রজন্মের প্রতি প্রশ্ন
গৈলার ঐতিহ্যবাহী শিমুল ভাঙার খালের পাশে শতবর্ষ প্রাচীন গৈলা বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে আজও দাঁড়িয়ে আছে তাঁর সমাধিফলক—প্রতীক হয়ে বিপ্লবের, সাহসের, আত্মত্যাগের। অথচ বর্তমান প্রজন্মের ক’জন জানে সেই ইতিহাস?
শহীদ তারকেশ্বর সেনগুপ্ত কেবল গৈলার নয়, সমগ্র বাঙালির গৌরব। তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ শুধু পাথরের স্তম্ভ নয়—এটি আমাদের স্বাধীনতার অগ্নিঝরা ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল।