
ধর্মের জাত?

রেজুয়ান আহম্মেদ
গ্রামের নাম কালিমুদ্দিনপুর। নামটা শুনলেই কেমন যেন একটা গম্ভীর ভাব চলে আসে—মনে হয় যেন এক বুড়ো দরবেশ গম্ভীর গলায় নামটা উচ্চারণ করছেন, \"কা-লি-মু-দ্দি-ন-পু-র...\"
লোকমুখে শোনা যায়, বহু বছর আগে এক সাধক এসেছিলেন এই গ্রামে—নাম ছিল কালিমুদ্দিন। তিনি নাকি বলতেন, \"ধর্ম মনের বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে, মানুষের হৃদয়ে বাস করে। যে যেটা বিশ্বাস করবে সেটাই তার নিজস্ব ধর্ম।\" সেই থেকেই গ্রামের নাম হয়ে যায় কালিমুদ্দিনপুর।
আশ্চর্য এই গ্রামটার গল্প আরও মজার। এখানে ধর্ম মানে বিভাজন নয়—বরং মিল। সকালবেলা মসজিদ থেকে আজান আসে, মন্দিরে শাঁখ বেজে ওঠে, গির্জায় বাজে ঘণ্টা, আর পহেলা বৈশাখে পুরো গ্রামটাই রঙে রঙিন—হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই একাকার হয়ে যায়।
ভোরের সময় পাখির ডাক আর গরুর ডাক একসঙ্গে মিশে এমন এক মধুর সুর তোলে, যেন প্রকৃতি নিজেই গান গাইছে। মানুষ যেমন এই গ্রামকে ভালোবাসে, তেমনি পশুপাখিরাও যেন এখানে আপন হয়ে উঠেছে—ছাগল ডাকে, হাঁস ক্যাঁক-ক্যাঁক করে, মুরগি কুক্কুক-কু-কু ডাকে। শুধু খামারে নয়, এরা গল্পেও ঢুকে পড়ে, খেলাধুলায়ও হাজির হয়।
আর এই গ্রামে আছে এক বিখ্যাত আড্ডাস্থল—এক পুরনো বিশাল বটগাছ। গাছটার ছায়ায় মাটির বেঞ্চিতে বসে জমে আড্ডা—ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে রামবাবু ঘোষ (পঞ্চায়েতের প্রবীণ সদস্য), মোতাহার মিয়া (মসজিদের মুয়াজ্জিন, আবার দারুণ রসিক মানুষ), ফাদার জোসেফ (গির্জার পাদ্রী, শান্ত মানুষ), আর হরেন মুদি (তার দোকানে নাকি জিনিস কম, গল্প বেশি)।
সেদিন বিকেলটা ছিল একটু অন্যরকম। গ্রীষ্মের মৃদু হাওয়া, দূরে আকাশে কালো মেঘ, আর পাখিরা বাসায় ফিরছে। এমন সময় মোতাহার মিয়া এক চুমুক চা খেয়ে হঠাৎ বললেন—
\"বলুন তো, গরু-ছাগল-মুরগি—ওদের কি কোনো ধর্ম আছে?\"
রামবাবু তখন লালচায়ের কাপ ঠোঁটে নিয়ে থেমে গেলেন। চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বললেন—
\"এই প্রশ্ন কি আপনি সকালে কাঁচা লঙ্কা খেয়ে করলেন?\"
সঙ্গে সঙ্গে হাসির ঝড় উঠল। ফাদার জোসেফ হেসে কাঁপছেন, হরেন মুদি তো হেসে পেছনে হেলেছেন।
কিন্তু মোতাহার মিয়া থামলেন না। আবার বললেন—
\"ধরুন, আমি রামবাবুর কাছ থেকে একটা গরু কিনলাম। এখন, রামবাবু হিন্দু—তাহলে গরুটাও হিন্দু? আর আমি কিনে নিলে গরুটা মুসলমান হয়ে যাবে? এই বদলটা কেমন করে হয়?\"
ফাদার জোসেফ তখন হেসে বললেন—
\"তাহলে আমার হাঁসগুলো খ্রিস্টান! যদিও ওদের ব্যাপটিজম করিনি!\"
আবারও হাসির রোল। কিন্তু ওই একটাই প্রশ্ন যেন সবার মনে গেঁথে গেল।
পরদিন সকাল থেকে পুরো গ্রামে হৈচৈ! চায়ের দোকান, স্কুলের বারান্দা, হাটের মোড়—সবখানে আলোচনা, \"পশুপাখির ধর্ম কী?\"
কেউ বলছে, \"মুরগি তো হাঁড়ির ধর্ম জানে!\"
কেউ বলে, \"গরু তো গোমাতা, হিন্দু হতেই হবে!\"
আরেকজন ফিসফিস করে বলে, \"ধর্মের আবার গন্ধ হয় নাকি?\"
তর্ক-বিতর্ক যখন থামছেই না, তখন সবাই সিদ্ধান্ত নিল—সব ধর্মগুরুদের কাছে গিয়ে জেনে আসা যাক।
তাই একে একে হাজির হল সবাই—মন্দিরের পুরোহিত শ্যামলবাবুর কাছে, মসজিদের ইমাম মৌলভি আব্দুল হকের কাছে, গির্জার ফাদার জোসেফ তো আগেই আছেন, আর বৌদ্ধ ভিক্ষু ধর্মরত্নও বাদ গেলেন না।
শ্যামলবাবু বললেন—
\"গরু তো আমাদের গোমাতা। সে তো হিন্দু, জন্ম থেকেই!\"
মৌলভি সাহেব বললেন—
\"পশুর কোনো ধর্ম নেই। হালাল হলে খাই, না হলে খাই না। ব্যস।\"
ফাদার জোসেফ আবার বললেন—
\"আমি তো হাঁসদের গির্জায় নিয়ে যাইনি, তাহলে খ্রিস্টান কীভাবে হবে?\"
ভিক্ষু ধর্মরত্ন হেসে বললেন—
\"জীবহত্যা আমরা করিই না। এইসব ভাবনা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার কী?\"
তবুও মন ভরল না। তখন প্রস্তাব উঠল—\"চলো, পাহাড়ের পাদদেশে নির্গুণানন্দ স্বামীর আশ্রমে যাই। তিনি নাকি প্রকৃতির গভীর ভাষা বোঝেন।\"
এক সকালে রওনা হলেন সবাই—রামবাবু, মোতাহার মিয়া, ফাদার জোসেফ, হরেন মুদি আর কয়েকজন স্কুলের মাস্টার মশাই।
স্বামীজি তখন গভীর ধ্যানে। তাঁকে দেখে সবার মন প্রশান্তিতে ভরে উঠল। প্রশ্ন শুনে তিনি ধীরে চোখ মেললেন, মুখে হালকা হাসি। বললেন—
\"তোমরা পশুপাখির ধর্ম খুঁজছো, অথচ নিজের ধর্ম কতটা বোঝো?\"
মোতাহার মিয়া নিচু গলায় বললেন—
\"তাহলে কি পশুপাখির কোনো ধর্মই নেই?\"
স্বামীজি মাথা নাড়িয়ে বললেন—
\"না, নেই। ধর্ম মানুষের তৈরি এক বিশ্বাস। পশুপাখি তো প্রকৃতির সন্তান—তারা ধর্ম জানে না, জানার দরকারও হয় না। তারা শুধু প্রকৃতির নিয়মে চলে, মায়া জানে, প্রেম বোঝে—কিন্তু ধর্মের রাজনীতি বোঝে না।\"
সবাই নিঃশব্দ। যেন হাওয়ার শব্দটাই বড় হয়ে উঠেছে।
স্বামীজি আবার বললেন—
\"তোমরা যখন কোনো গরুকে পূজায় উৎসর্গ করো, কিংবা কোরবানিতে জবাই করো—সেটা তোমাদের ধর্মীয় আচার। গরুর কাছে তার মানে নেই। সে শুধু তোমার চোখে তাকিয়ে থাকে—ভালোবাসা আর ভয়ের মাঝখানে এক অদ্ভুত বিস্ময় নিয়ে।\"
এই কথাগুলো শুনে আর কেউ কিছু বলতে পারল না।
সবাই ফিরে এলো গ্রামে। মনটা কেমন যেন বদলে গেল। কেউ কিছু বলেনি, কিন্তু যেন মনে মনে সবাই একটু একটু করে বুঝে গেল কিছু কথা।
ফিরে এসে মোতাহার মিয়া বললেন—
\"পশুপাখির কোনো ধর্ম নেই।\"
তখন হরেন মুদি চোখ টিপে বললেন—
\"তবে কি আমার খাসিটা বৌদ্ধ হয়ে গেল? কাউকে তো কখনো কামড়ায় না!\"
আবারও বটগাছের নিচে হাসির রোল।
তবুও কোথাও যেন প্রশ্নটা রয়ে গেল—
\"তাহলে আমার হাঁসটা হিন্দু, না মুসলমান?\"
হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর মানুষের হাতে নেই—প্রকৃতির কোলে ই তার ঠিকানা।
শেষ।