
‘তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম’

প্রিয় ফাতেমা আপা। মা বাবার রাখা নাম ফাতেমা জোহরা ইসলাম। কারো কাছে আবার মিসেস ইসলাম। লুটনের পাকিস্তানি, ইন্ডিয়ান, বাংলাদেশি মানুষের প্রিয়জন ফাতেমা আপাও বিদায় নিলেন।
১৯৮৬-তে এদেশে আসার পর আমি ও আমার স্ত্রীর সাথে তার প্রথম মোলাকাত লুটনের সেই সময়ের কম্যুনিটি লাইব্রেরিতে (যেখানটাতে বর্তমান জালালাবাদ মসজিদ প্রতিষ্ঠিত)। সেই থেকে আজ ৪০ বছর এক সাথে চলা।
১৯৭৭ এ এদেশে পা রাখার পর থেকেই হয়ে উঠেছিলেন লুটনের বাংলাদেশি কম্যুনিটির একজন অপরিহার্য মানুষ। বাংলাদেশ থেকে সবেমাত্র ফ্যামিলি আসা শুরু হয়েছে। মহিলাদের জন্য ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্হা করা,বাংলা ক্লাস শুরুর জন্য কাউন্সিলের সাথে দেন দরবার , মহিলা ও শিশুদের জন্যে সাঁতার শিখার ব্যবস্হা সবই স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ফাতেমা আপা। সব কিছুই তিনি করে গিয়েছেন নীরবে। যশ আর খ্যাতির পিছনে ছুটেননি তিনি। ফাতেমা আপা যেখান থেকে শুরু করেছেন সেখানে কেবল তিনিই ছিলেন লুটনের মাতা ভগ্নি ভ্রাতা আর জায়ার আশ্রস্হল।
ফাতেমা আপা ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাষ্টার্স। তারপর কিছুদিন কুলাউড়া কলেজে অধ্যাপনা। তারপর বিয়ে করে এদেশে আগমন। এর পর থেকেই কম্যুনিটির মানুষের সাথে তার আমৃত্যু পথচলা।
তাঁর অত্যন্ত সুপরিচিত একখানা হলুদ রংয়ের চমকপ্রদ মিনি কুপার ছিল। সুদীর্ঘ ২০টি বছর তিনি তাঁর এই গাড়িটি চালিয়েছেন কম্যুনিটির প্রয়োজনে। ঘর থেকে তুলে নিয়ে ইংলিশ ক্লাসে পৌছে দেওয়া , অসুস্হ মহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, মহিলা আর শিশুদের সাঁতার শিখতে সুইমিং পুলে নিয়ে আবার নিরাপদে ঘরে পৌছে দেওয়া। অবলীলায় তিনি করে গেছেন সমস্ত কিছু। তিনি এক অদ্ভুত ধীশক্তির মহিলা। তিনি যেটা বিশ্বাস করতেন, লেগে থাকতেন তাঁর পিছনে। হার মানতে রাজি ছিলেন না কখনও। স্বপ্ন দেখতেন তাঁর কম্যুনিটি একদিন শিক্ষা ও সমাজ বিনির্মাণে নেতৃত্ব দেবে। আজকের আমাদের কম্যুনিটির সাফল্যের পিছনে তার অবদান অনস্বীকার্য।
ফাতেমা আপা আপাদমস্তক একজন ধার্মিক মহিলা ছিলেন। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি পছন্দ করতেন না। ধর্মীয় ও সামাজিক,সাংস্কৃতিক অনেক সংগঠনের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন।
CYCD ছিল তাঁর 2nd home. পূর্বাচল (The Eastern sky) এর জন্মলগ্ন থেকেই তিনি ছিলেন আমাদের সাথে। পুর্বাচলের ব্যানারে অনেক স্টেইজ নাটকে তিনি আমাদের সাথে অভিনয় করেছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি ও কোরাশে গলা মিলিয়েছেন।
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি আমাদেরকে সাহস যুগিয়েছেন পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের বেডে। আমি তাকে অনুরোধ করেছিলাম তার সেই হলুদ মিনির একটা ছবির জন্য। ইচ্ছে ছিল সেই গাড়ি আর আপাকে নিয়ে কিছু স্মৃতিচারণ করব , তিনি সেগুলো পাঠিয়ে ছিলেনও কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি আমাদের কাছ থেকে চিরতরে বিদায় নিলেন।তিনি সেগুলো পাঠিয়ে ছোট্ট একটি Text জুড়ে দিয়েছিলেন। তার সেই কথাগুলো আমাদের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে অনন্তকাল।
আমি জীবনে অনেককে কখনও কাঁদতে দেখিনি কিন্তু ফাতেমা আপার শোকসভায় দাঁড়িয়ে অঝোর ধারায় তাদেরকে কাঁদতে দেখেছি। কম্যুনিটির ভালোবাসায় তিনি সিক্ত হয়েছেন। তাঁর প্রাণপ্রিয় CYCD র সতীর্থরা তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর জন্য শোকসভা ও স্মৃতিচারণ করেছেন। পূর্বাচল ও শোকসভায় মিলিত হয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। কম্যুনিটির চলার পথে তিনি আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন আজীবন।
“এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ / মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।”
....ওপারে ভালো থেকো আপা।