img

‘তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম’

প্রকাশিত :  ১৯:১৯, ২৬ মে ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৯:৫৩, ২৬ মে ২০২৫

‘তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম’

প্রিয় ফাতেমা আপা। মা বাবার রাখা নাম ফাতেমা জোহরা ইসলাম। কারো কাছে আবার মিসেস ইসলাম। লুটনের পাকিস্তানি, ইন্ডিয়ান, বাংলাদেশি মানুষের প্রিয়জন ফাতেমা আপাও বিদায় নিলেন।

১৯৮৬-তে এদেশে আসার পর আমি ও আমার স্ত্রীর সাথে তার প্রথম মোলাকাত লুটনের সেই সময়ের কম‍্যুনিটি লাইব্রেরিতে (যেখানটাতে বর্তমান জালালাবাদ মসজিদ প্রতিষ্ঠিত)। সেই থেকে আজ ৪০ বছর এক সাথে চলা।

১৯৭৭ এ এদেশে পা রাখার পর থেকেই হয়ে উঠেছিলেন লুটনের বাংলাদেশি কম‍্যুনিটির একজন অপরিহার্য মানুষ। বাংলাদেশ থেকে সবেমাত্র ফ‍্যামিলি আসা শুরু হয়েছে। মহিলাদের জন‍্য ইংরেজি শিক্ষার ব‍্যবস্হা করা,বাংলা ক্লাস শুরুর জন‍্য কাউন্সিলের সাথে দেন দরবার , মহিলা ও শিশুদের জন্যে সাঁতার শিখার ব‍্যবস্হা সবই স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ফাতেমা আপা। সব কিছুই তিনি করে গিয়েছেন নীরবে। যশ আর খ‍্যাতির পিছনে ছুটেননি তিনি। ফাতেমা আপা যেখান থেকে শুরু করেছেন সেখানে কেবল তিনিই ছিলেন লুটনের মাতা ভগ্নি ভ্রাতা আর জায়ার আশ্রস্হল।

ফাতেমা আপা ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাষ্টার্স। তারপর কিছুদিন কুলাউড়া কলেজে অধ‍্যাপনা। তারপর বিয়ে করে এদেশে আগমন। এর পর থেকেই কম‍্যুনিটির মানুষের সাথে তার আমৃত‍্যু পথচলা।

তাঁর অত্যন্ত সুপরিচিত একখানা হলুদ রংয়ের চমকপ্রদ মিনি কুপার ছিল। সুদীর্ঘ ২০টি বছর তিনি তাঁর এই গাড়িটি চালিয়েছেন কম‍্যুনিটির প্রয়োজনে। ঘর থেকে তুলে নিয়ে ইংলিশ ক্লাসে পৌছে দেওয়া , অসুস্হ মহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, মহিলা আর শিশুদের সাঁতার শিখতে সুইমিং পুলে নিয়ে আবার নিরাপদে ঘরে পৌছে দেওয়া। অবলীলায় তিনি করে গেছেন সমস্ত কিছু। তিনি এক অদ্ভুত ধীশক্তির মহিলা। তিনি যেটা বিশ্বাস করতেন, লেগে থাকতেন তাঁর পিছনে। হার মানতে রাজি ছিলেন না কখনও। স্বপ্ন দেখতেন তাঁর কম‍্যুনিটি একদিন শিক্ষা ও সমাজ বিনির্মাণে নেতৃত্ব দেবে। আজকের আমাদের কম‍্যুনিটির সাফল‍্যের পিছনে তার অবদান অনস্বীকার্য।

ফাতেমা আপা আপাদমস্তক একজন ধার্মিক মহিলা ছিলেন। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি পছন্দ করতেন না। ধর্মীয় ও সামাজিক,সাংস্কৃতিক অনেক সংগঠনের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন।

CYCD ছিল তাঁর 2nd home. পূর্বাচল (The Eastern sky) এর জন্মলগ্ন থেকেই তিনি ছিলেন আমাদের সাথে। পুর্বাচলের ব‍্যানারে অনেক স্টেইজ নাটকে তিনি আমাদের সাথে অভিনয় করেছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি ও কোরাশে গলা মিলিয়েছেন।

জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি আমাদেরকে সাহস যুগিয়েছেন পরামর্শ দিয়েছেন।

তিনি যখন ক‍্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের বেডে। আমি তাকে অনুরোধ করেছিলাম তার সেই হলুদ মিনির একটা ছবির জন্য। ইচ্ছে ছিল সেই গাড়ি আর আপাকে নিয়ে কিছু স্মৃতিচারণ করব , তিনি সেগুলো পাঠিয়ে ছিলেনও কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি আমাদের কাছ থেকে চিরতরে বিদায় নিলেন।তিনি সেগুলো পাঠিয়ে ছোট্ট একটি Text জুড়ে দিয়েছিলেন। তার সেই কথাগুলো আমাদের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে অনন্তকাল।

আমি জীবনে অনেককে কখনও কাঁদতে দেখিনি কিন্তু ফাতেমা আপার শোকসভায় দাঁড়িয়ে অঝোর ধারায় তাদেরকে কাঁদতে দেখেছি। কম‍্যুনিটির ভালোবাসায় তিনি সিক্ত হয়েছেন। তাঁর প্রাণপ্রিয় CYCD র সতীর্থরা তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর জন্য শোকসভা ও স্মৃতিচারণ করেছেন। পূর্বাচল ও শোকসভায় মিলিত হয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। কম‍্যুনিটির চলার পথে তিনি আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন আজীবন।

“এনেছিলে সাথে করে মৃত‍্যুহীন প্রাণ / মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।”

....ওপারে ভালো থেকো আপা।

img

নজরুল-চিন্তা ও আগামীর বাংলাদেশ

প্রকাশিত :  ১৯:০৪, ০৪ জুলাই ২০২৫

জয়দ্বীপ রায়

আমি মাঝে মাঝে ভাবি—আজ যদি কবি নজরুল ইসলাম জীবিত থাকতেন, তবে তিনি কী করতেন? যদিও এই প্রশ্নটি স্থান, কাল ও পাত্রের সূচকগুলোকে বিবেচনায় না নিয়েই করা হচ্ছে, তারপরও কিছু আকাঙ্ক্ষা মনের গভীর থেকে উঠে আসে, যা প্রকৃতি প্রদত্ত কিছু সত্য উপলব্ধির ফসল।

আমার মতে, এটি একটি যুক্তিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক মতও বটে যে নজরুল ইসলাম, একজন ধর্মপরায়ণ পরিবারের সন্তান হয়েও ধর্মের মূল উদ্দেশ্য—মানবকল্যাণ—উপলব্ধি করেছেন জ্ঞান, যুক্তি ও ঈশ্বর-চেতনার মাধ্যমে। তাইতো তিনি লিখেছেন:

“খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে,

প্রলয়-সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে, প্রভু নিরজনে...”

এই উপলব্ধি কোথা থেকে এসেছে? আমার ধারণা, ঈশ্বরের করুণা ব্যতিরেকে এমন চিন্তা সম্ভব নয়। তবে এটাও আমার বিশ্বাস—সারাক্ষণ ঈশ্বরচিন্তা করলেও তাঁর করুণা সবসময় নাও আসতে পারে। এখানে গ্রন্থগুলোতে ঈশ্বর যেখানে মানুষের মানবতাকে মূল্য দিয়েছেন, সেই ধর্মীয় উপলব্ধির গভীরতাই নজরুলকে অনন্য করে তোলে।

নজরুল এক অনন্য মাত্রায় ঈশ্বর ও মানবতার সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। তিনি সব ধর্মের প্রতি সম্মান রেখেছেন এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে নিজের জীবনে ধারণ করেছেন। তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা নয়, বরং অসীম ঈশ্বরের প্রতি তাঁর বিনীত নিবেদন ও আনুগত্য, যেখানে তিনি সকল ধর্মের ঈশ্বরের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে ইসলামি ধর্মীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তিনি যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা একজন অমুসলিম পাঠকের মনেও ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা ও সংবেদনশীলতা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম—যেমনটি দুই বাংলাতেই আমাদের বাঙালি মননে অনেকের মধ্যেই ঘটেছে।

নজরুলের এই সাহিত্য-শক্তির কারণেই তাঁর ধর্ম, নানান সংস্কৃতি ও বিশ্বময় বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি করে। তিনি এতটাই বৈচিত্র্যে আকৃষ্ট সাহিত্যিক ছিলেন, যিনি সারা পৃথিবীর বৈচিত্র্যকে তাঁর সৃষ্টিতে ও জীবনবোধে এক বৈশ্বিক রূপ দিয়েছেন। যেখানে ছিল না কোনো গণ্ডি ও সংকীর্ণতা। একজন কবি এত দারিদ্র্য ও সীমাবদ্ধতার মাঝেও কোনো অভিযোগ ছাড়াই কী রকম মুক্তমন নিয়ে নিজেকে বিকশিত করেছিলেন, আর বাঙালি মননকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় শুদ্ধ করেছিলেন।

বাংলা সাহিত্যে নজরুলের মতো করে শ্যামাসঙ্গীত, ভজন বা সনাতন ধর্মীয় গানে মৌলিক অবদান আর কেউ রাখেননি। এই বৈচিত্র্যই তাঁকে তুলনার ঊর্ধ্বে স্থাপন করে। সাহিত্যের প্রতিটি শাখা স্বতন্ত্র—এখানে কারও সাথে কারও তুলনা হয় না, কারণ এই ক্ষেত্রটি বিশাল, যার কোনো কোলকিনারা নেই। এখানে নানান সাহিত্য উপাদান বা কনটেন্ট উপস্থাপনাই গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প ও সাহিত্যের বিজ্ঞানের নিয়মের বিচারে একেক জনের সৃষ্টি একেক জনকে অনন্য সাধারণ হিসেবে স্থান করে দিয়েছে।

উপনিবেশিক রাজনীতির সংকীর্ণ প্রয়োজনে যখন হিন্দু-মুসলমান বিভাজন সমাজে প্রকট হয়ে উঠল—যা মুঘল আমলেও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় ছিলই না—তখন নজরুল হয়ে উঠলেন জাতির বিবেক। তিনি শুধু কবিই ছিলেন না, ছিলেন সাম্যবাদী চিন্তাবিদ, রাজনৈতিক ও সমাজকর্মী। বিপ্লবী রাজনীতিবিদদের সাংস্কৃতিক মানের প্রশ্নে তিনি তাদেরকে তাঁর সাহিত্যরস দিয়ে পরিচালিত করেছেন, শক্তি জুগিয়েছেন।

সম্প্রতি নজরুলের জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কিছু সমসাময়িক রাজনৈতিক নেতা তাঁকে স্মরণ করে বাণী দিয়েছেন। এটি প্রশংসনীয়। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম—সাম্য, বিদ্রোহ, শোষণবিরোধিতা ইত্যাদি—সব শব্দই ব্যবহৃত হয়েছে, শুধু “অসাম্প্রদায়িকতা” শব্দটি নেই। কেন? এই শব্দ ব্যবহার করলে কি বেশিরভাগ সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন মানুষগুলোর বিশ্বাসে আঘাত আসতে পারে? এই বিশ্বাস কি তার ধর্মীয় চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক? না তার অজ্ঞানতা বা না বোঝার ফলে বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে আজ সংক্রামিত হয়েছে? আমার মতে, এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কবি নজরুলকে বোঝা খুবই গুরুত্ব বহন করবে।

অসাম্প্রদায়িকতা কি সাম্যের অংশ নয়? অন্য ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর প্রতি সম্মান, নারীর সমমর্যাদা, ধর্মভিত্তিক বৈষম্য রোধ—এগুলো কি সাম্যের পরিপূরক নয়? তাহলে নজরুলের সাম্যের দর্শনে এই বিষয়গুলো কি অনুপস্থিত থাকবে, যারা এই শব্দগুলো ব্যবহার করছেন?

আমরা সবাই জানি, নজরুল ভারতের কবি হলেও বাংলাদেশ তাঁর শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার পেয়েছে। এই পাওয়া আমাদের জন্য বাড়তি পাওয়া, কিন্তু ভারতের অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষদের ক্ষোভ আছে এই বিষয়ে। এই অমূল্য রত্নকে যদি শুধু রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করি—সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি বাদ দিয়ে কেবল দলীয় ব্যাখ্যায় ব্যাখ্যাত করি—তাহলে আমরা আসলে কী শিখছি? ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকেও কি এমনটাই শেখাব?

এই প্রশ্নগুলোর সাথে ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও জাতিসত্তাভিত্তিক বাংলাদেশের ভাগ্য জড়িত। তথাকথিত \"বহুত্ববাদ\"ও এই প্রশ্নগুলোর সাথেই সম্পর্কিত।

বহুত্ববাদ মানে শুধু কারও ওপর ঘটে যাওয়া অন্যায় শুধরে দেওয়া নয়—বরং সকল মত, জাতি ও ধর্মের সহাবস্থান নিশ্চিত করা। নিজের বিশ্বাসকে অন্যের ওপর চাপিয়ে না দেওয়ার সহিষ্ণুতা। এই বহুত্ববাদই বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য। এই ভূখণ্ডে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান—সবাই যুগে যুগে ধর্ম প্রচার করেছেন, আবার সহঅবস্থানেরও দৃষ্টান্ত রেখেছেন।

সভ্যতা এগিয়ে যাওয়ার কথা বলে, পেছনে ফিরে যাওয়াকে কখনো উৎসাহ দেয় না। তাই বাঙালির প্রকৃত পরিচয়—বৈচিত্র্য-বিশ্বাসী ও পরমত সহিষ্ণু জাতি—যদি জোর করে চেপে ধরা হয়, তবে প্রকৃতি একদিন এর প্রতিক্রিয়া দেবে—যা আমাদের জন্য কল্যাণকর হবে না।

এটাই সামাজিক বাস্তবতা।

গণতন্ত্রে বিশ্বাস যদি সত্যিই কেউ করে, তাহলে তা কখনোই সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী বা ধর্মীয় সহিষ্ণুতাকে অবজ্ঞা করে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সুইজারল্যান্ড মাত্র কয়েক হাজার ইতালিয়ান ভাষাভাষীর জন্য রোমানশ ভাষাকে জাতীয় ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। আমরা ইউরোপে থাকি, কিন্তু ইউরোপ থেকে কী শিখছি? দেশে কী ফিরিয়ে নিচ্ছি? নজরুলের কথা বলছি, কিন্তু তাঁকে বুঝে? না না বুঝে?

যুক্তরাজ্য থেকে আইনে ডিগ্রি নিয়ে ব্যারিস্টার হয়ে অনেকেই দেশে রাজনীতি করছেন বা করবেন, কিন্তু দেশে গিয়ে বিদেশের সোনা লোহা হয়ে যায় কেন? এটা সামাজিক বাস্তবতার কাছে আত্মসমর্পণ করে অস্বীকার করা নয়, যুক্তির কষ্ঠিপাথরে থেকেও নিজের সাথে প্রতারণা করে অবিশ্বাস করা।

আগামী দিনে যারা রাজনীতি করবেন, তাদের নৈতিকতাবোধ কি বিবেচনায় আসবে না? যদি না আসে, তাহলে কি আমরা একই বৃত্তে ঘোরপাক খাবো? আগাবো না?

এই প্রশ্নগুলো আজকের বিশ্বায়িত রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির যুগে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


জয়দ্বীপ রায়: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংস্কৃতি কর্মী, লন্ডন।