img

ফেরার শেষ প্রহর!

প্রকাশিত :  ০৭:৫৭, ০৭ মে ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৯:২০, ০৭ মে ২০২৫

রেজুয়ান আহম্মেদ

সেদিন সন্ধ্যার শেষ আলোটা দুবাইয়ের আকাশে কিছুটা ভিন্নরকম লাগছিল। চারপাশে হালকা নীলচে বিষণ্নতা—সূর্যটা যেন ক্লান্ত হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। আলো-ছায়ার খেলায় শহরের সুউচ্চ কাঁচঘেরা দালানগুলো আরও নিঃস্তব্ধ হয়ে উঠছিল—নির্জন, নির্বাক। মনে হচ্ছিল, শহরটা যেন কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু কেউ তা শুনছে না।

তারিখটা ছিল ২৪ এপ্রিল ২০২৫। আমি আর তানভীর কয়েকদিন আগে এখানে এসেছি। যদিও বলা হয় ব্যবসার প্রয়োজনে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে জানি—আমরা যেন কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছি। হয়তো কোনো পুরোনো অনুভূতি, নয়তো হারিয়ে ফেলা নিজেকেই।

আবাস ছিল আল-কেসিসে, সাহারা বিল্ডিংয়ের ১৫৩ নম্বর ফ্ল্যাটে। ছোট ভাই ফেরদৌস ঢাকায় বিশেষ এক কাজে গেছে, তাই তারই সাজানো বাসাটাই আমাদের অস্থায়ী ঠিকানা ছিল। জানালার বাইরে শহরটা ঝলমলে আলোয় সজ্জিত—রাস্তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, পাশে ব্যস্ত রেস্তোরাঁ। কিন্তু এই নিখুঁত ছবির মাঝেও কোথা থেকে যেন এক ধরনের শূন্যতা এসে ভর করছিল। কিছু একটা যেন হারিয়ে গেছে, কিন্তু ঠিক কী, তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

সেই রাতটা এখনো মনে আছে। সময় তখন প্রায় বারোটা। হঠাৎ তানভীর বলল, “ভাই, চলেন, একটু বাইরে হেঁটে আসি।” আমরা নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়লাম। শহরের এক সরু গলির ফুটপাত ধরে হাঁটছিলাম। রাস্তার সোনালি বাতিগুলো পায়ে পায়ে ছায়া ফেলছিল, আর শহরের নীরবতা যেন ঘনীভূত হচ্ছিল।

হঠাৎ চোখে পড়ল—এক তরুণ গলির পাশে বসে আছে। কাঁধ ঝুলে পড়েছে, মুখে ক্লান্তির ছাপ, চোখজোড়া অশ্রুসিক্ত। বয়স বড়জোর পঁচিশ। এমনভাবে বসে আছে, যেন জীবনের সমস্ত ভার বহন করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “ভাই, কী হয়েছে? কাঁদছেন কেন?” সে চমকে উঠে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল, যেন বিশ্বাস করতে পারছে না—কেউ তার দিকে ফিরে তাকিয়েছে।

নাম জিজ্ঞেস করতেই কাঁপা গলায় বলল, “আমার নাম কামাল। শরীর ভালো নেই ভাই, সব শেষ হয়ে গেছে। দেশে ফেরারও কোনো উপায় নেই।” তার গলার হাহাকার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল।

জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার বাড়ি কোথায়?” বলল, “সিলেট, গোয়াইনঘাট, নন্দিরগাঁও গ্রাম।”

আমরা পাশে বসে পড়লাম। তার মুখ খুলতেই যেন এক দীর্ঘ কষ্টের গল্পের দরজা খুলে গেল। “চার বছর ধরে দুবাইয়ে আছি। একবারও দেশে যাওয়া হয়নি। ইচ্ছা তো হয়, কিন্তু টাকা কোথায়, ভাই? ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়েছি। দাদির কোলে বড় হয়েছি। সেও এখন নেই। রেলস্টেশন আর মাজারেই কেটেছে শৈশব। প্লাস্টিক কুড়িয়ে খেয়েছি।”

আমি নিঃশব্দ। তানভীরও চুপ। তার প্রতিটি শব্দ বুকের ভেতর আঘাত করছিল। “দেশে সামান্য জমি ছিল। বিক্রি করে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলাম দুবাই। রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করতাম। একদিন কাজ করতে গিয়ে পা ভেঙে যায়, মেরুদণ্ডেও চোট লাগে। এরপর আর কেউ কাজ দেয়নি। কিছুদিন খেজুর বাগানে কাজ করলাম। তারপর এক রাতে সবকিছু চুরি হয়ে গেল—পাসপোর্ট, টাকা, আইডি। সেই থেকে রাস্তায়, আর উঠে দাঁড়াতে পারিনি।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “বাংলাদেশি ভাইয়েরা কিছু সাহায্য করেনি?” সে মাথা নাড়িয়ে বলল, “ভাই, এখানে নিজেরাই একে অপরকে ঠেলে ফেলে দেয়। সাহায্য তো দূরের কথা, কেউ পাশে দাঁড়ায় না।” তার চোখে যে যন্ত্রণা দেখলাম, তা ভাষায় বর্ণনার বাইরে।

আমি বললাম, “চলো ভাই, আজ রাতটা অন্তত আমাদের সঙ্গে কাটাও। দেখি, দেশে ফেরার ব্যবস্থা করা যায় কি না।” সে শান্ত গলায় বলল, “ভাই, আপনারা ভালো মানুষ। কিন্তু আমি আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। অনেকেই বলেছে—‘দেখছি’, ‘হবে’, ‘চিন্তা করো না’—কিন্তু কেউ কথা রাখে না, ভাই। আমি আর আশায় বুক বাঁধি না।” তার কণ্ঠ যেন বাতাসে কেঁপে উঠছিল।

আমরা তাকে কিছু খাবার দিলাম, একটু সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। তবু সে ধীরে উঠে দাঁড়াল। চোখ মুছে বলল, “ভালো থাকবেন ভাই। যদি কোনোদিন দেশে ফিরতে পারি, শাহজালালের মাজারে খুঁজবেন। হয়তো আমার কোনো ছায়া সেখানে পড়ে থাকবে।” তারপর সে গলির মোড় ঘুরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। যেন এক জীবন্ত অস্তিত্ব ধোঁয়ার মতো বিলীন হয়ে গেল।

পরদিন সকাল থেকে আমরা তাকে খুঁজেছি—রাস্তায়, দোকানে, এমনকি পুলিশ স্টেশনেও। কোথাও নেই। মনে হলো, সে যেন রাতের কোনো স্বপ্ন ছিল। তানভীর চুপ করে বলল, “ভাই, জানেন কি? কামালদের মতো কতজন এই শহরে হারিয়ে যায়? কেউ জানে না। কেউ তাদের কথা লিখেও রাখে না।” আমি শুধু বললাম, “তাই লিখছি। যেন অন্তত কেউ জানে—একজন কামাল ছিল, যার চোখে স্বপ্ন ছিল, বুকে কান্না জমা ছিল, আর দেশে ফেরার এক তীব্র আকুতি ছিল।”

আমরা আর কখনো কামালকে খুঁজে পাইনি। তবু আজও কোনো কোনো রাতে মনে হয়—তার সেই চোখের জল, বুকের হাহাকার আর মায়ের কবরের পাশে শুয়ে পড়ার ব্যাকুলতা এই মরুভূমির শহরের বাতাসে আজও ভেসে বেড়ায়। আর আমার ভেতরেও তা বৃষ্টির মতো ঝরে—নিঃশব্দে।

img

প্রথম সপ্তাহেই জমজমাট ইসলামী বইমেলা

প্রকাশিত :  ০৯:৪৮, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

শুরুতেই জমে উঠেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন আয়োজিত মাসব্যাপী ইসলামী বইমেলা । সাধারণত প্রথম সপ্তাহে মেলায় দর্শনার্থী ও ক্রেতার ভিড় তুলনামূলক কম থাকে, কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। শুরু থেকেই পাঠক-দর্শনার্থীর উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো, ফলে মেলায় প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে।

শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর) ছুটির দিনে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে দর্শনার্থীর ভিড় ছিল উপচেপড়া। কেউ বই দেখেছেন, কেউ কিনেছেন, আবার কেউ লিটলম্যাগ কর্নারে বসে আড্ডা দিয়েছেন তরুণ লেখক ও পাঠকদের সঙ্গে। নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের অনুষ্ঠানও হয়েছে।

গার্ডিয়ান পাবলিকেশনসের জেনারেল ম্যানেজার নাজমুল হুদা জানান, এবারের মেলায় শুরু থেকেই পাঠকের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘মেলা শুরু হয়েছে মাত্র এক সপ্তাহ আগে, এর মধ্যেই পাঠকদের আনাগোনা বেড়েছে। এবারের বইমেলা নিয়ে প্রচারণাও বেড়েছে। শুরু থেকেই মূলধারার গণমাধ্যমে মেলার খবর প্রকাশ হওয়ায় পাঠকের আগ্রহও বেড়েছে।’

এখন পর্যন্ত সীরাত ও শিশু বিষয়ক বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ বেশি বলে জানান তিনি। শুক্রবার ছুটির দিনে বেচাবিক্রিও তুলনামূলক বেড়েছে।

সমকালীন প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী আরিফুল হক জানান, এবারের বইমেলা একেবারেই ভিন্ন। প্রথমবারের মতো বিদেশি প্রকাশনী অংশ নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘অন্য দিনের তুলনায় আজ বেশ ভালোই বিক্রি হচ্ছে। সামনে বিদেশি প্রকাশনীর অংশগ্রহণ আরও বাড়বে ইনশাআল্লাহ।’

মেলায় ঘুরতে আসা তাশরীফ মাহমুদ নামে এক পাঠক বলেন, ‘এখনো ঘুরে ঘুরে বই দেখছি, আড্ডা দিচ্ছি। আজ বই কিনবো না, সামনের সপ্তাহ থেকে পছন্দের বই কেনা শুরু করবো।’

প্রতি বছরের মতো এবারও রবিউল আওয়াল মাস উপলক্ষে মাসব্যাপী ইসলামী বইমেলার আয়োজন করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এবারের মেলায় ১৯৯টি স্টল বসানো হয়েছে। এতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন, দেশের স্বনামধন্য ইসলামী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও পুস্তক ব্যবসায়ীরা অংশ নিয়েছেন। পাশাপাশি মিশর, লেবানন ও পাকিস্তানের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানও অংশগ্রহণ করেছে।

এ ছাড়া মেলায় রয়েছে লেখক কর্নার, ফুড কর্নার, আলোচনা সভা ও কবিতা পাঠের আয়োজন। প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এবং ছুটির দিনে সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য মেলা উন্মুক্ত থাকবে।