img

গৈলার গর্ব: শহীদ তারকেশ্বর সেনগুপ্ত ও এক বিস্মৃত বিপ্লবের ইতিহাস

প্রকাশিত :  ০৯:৫৩, ২৯ আগষ্ট ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৯:৩৮, ২৯ আগষ্ট ২০২৫

গৈলার গর্ব: শহীদ তারকেশ্বর সেনগুপ্ত ও এক বিস্মৃত বিপ্লবের ইতিহাস

সংগ্রাম দত্ত

বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা গ্রামের প্রবেশমুখে, গৈলা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক নীরব ইতিহাসের সাক্ষী—শহীদ তারকেশ্বর সেনগুপ্তের স্মৃতিস্তম্ভ।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই স্তম্ভটি দেখলেও, ক’জনই বা জানে এর পেছনের রক্তঝরা ইতিহাস? ক’জনই বা জানে গৈলার গর্ব, বিপ্লবী তারকেশ্বর সেনগুপ্তের নাম?

জন্ম ও সংগ্রামের সূচনা

১৯০৫ সালের ১৫ এপ্রিল গৈলায় জন্ম নেন তারকেশ্বর সেনগুপ্ত। কৈশোর থেকেই তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯২০-এর দশকের প্রথমভাগে সতীর্থদের নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘গৈলা সেবাশ্রম’, যা পরে ‘গৈলা শহীদ স্মৃতিসংঘ’ নামে পরিচিত হয়।

আশ্রমটির আড়ালে ছিল বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের গোপন ঘাঁটি। শিবলিঙ্গকে তাঁরা শৌর্য ও বীর্যের প্রতীক হিসেবে বেছে নেন—ধর্মাচারের আড়ালে বিপ্লবকে এগিয়ে নেবার বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল। নৈশ বিদ্যালয়, পাঠাগার, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড—সবই ছিল বিপ্লবী চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার হাতিয়ার। শুধু হিন্দু যুবক নয়, স্থানীয় মুসলিম তরুণেরাও এতে যুক্ত হন, যা প্রমাণ করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে গিয়ে কেবল স্বাধীনতার স্বপ্নেই অনুপ্রাণিত হয়েছিল।

বঙ্গ থেকে ভারত: আন্দোলনের বিস্তার

গৈলার বিপ্লবীদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকেনি কেবল গ্রামে বা পূর্ববঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতবর্ষজুড়ে তাঁদের প্রভাব বিস্তার পায়। এর জেরেই ব্রিটিশ সরকার তাঁরকেশ্বরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর এর হিজলী বন্দিশিবিরে ।

শহীদের আত্মাহুতি

১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় হিজলী বন্দিশিবির থেকে সহযোদ্ধাদের নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন তারকেশ্বর সেনগুপ্ত। কিন্তু ব্রিটিশের বন্দুকের গুলিতে সেদিনই শেষ হয় তাঁর বিপ্লবী জীবনের অধ্যায়।

আজও সেই স্থান খড়্গপুরের হিজলী রেলস্টেশনের পাশে ইতিহাসের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বন্দিশিবিরের ওয়াচ টাওয়ারটি এখনও সাক্ষ্য দেয় এক রক্তাক্ত রাতের।

সেখানে খোদাই করা আছে বেদনার্ত কিন্তু গৌরবময় পঙক্তি:

“হিজলী বন্দিশিবিরে ইংরেজ শাসকের গুলিবর্ষণে দেশের মুক্তিযজ্ঞে তোমাদের শৌর্যময় আত্মাহুতি শ্রদ্ধানত অন্তরে স্মরণ করি।”

—তোমাদের গুণমুগ্ধ স্বদেশবাসী

গৈলায় নেতাজির পদচিহ্ন

অবিভক্ত ভারতবর্ষে বিপিনচন্দ্র পাল, মদন মোহন মালবীয়, স্বামী প্রণবানন্দ প্রমুখ মহাপুরুষের আগমনে গৈলা ইতিহাসে সমুজ্জ্বল। তাঁদের মধ্যে সর্বশেষে আসেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। শহীদ তারকেশ্বর সেনগুপ্তের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের জন্যই তিনি গৈলায় পা রাখেন।

আজকের প্রজন্মের প্রতি প্রশ্ন

গৈলার ঐতিহ্যবাহী শিমুল ভাঙার খালের পাশে শতবর্ষ প্রাচীন গৈলা বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে আজও দাঁড়িয়ে আছে তাঁর সমাধিফলক—প্রতীক হয়ে বিপ্লবের, সাহসের, আত্মত্যাগের। অথচ বর্তমান প্রজন্মের ক’জন জানে সেই ইতিহাস?

শহীদ তারকেশ্বর সেনগুপ্ত কেবল গৈলার নয়, সমগ্র বাঙালির গৌরব। তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ শুধু পাথরের স্তম্ভ নয়—এটি আমাদের স্বাধীনতার অগ্নিঝরা ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল।

img

বাংলাদেশের ইতিহাসে রাণী ভবানী ও নাটোর রাজবাড়ী: অর্ধবঙ্গেশ্বরীর গৌরবগাথা

প্রকাশিত :  ০৯:২৫, ০৪ নভেম্বর ২০২৫

সংগ্রাম দত্ত

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত নাটোর জেলা একসময় ছিল রাজকীয় ঐশ্বর্যের কেন্দ্রস্থল। এই জেলার সদর উপজেলায় অবস্থিত বিখ্যাত রাণী ভবানী রাজবাড়ী, বাংলার ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়ের সাক্ষী। জমিদারি প্রথার উত্থান-পতনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই রাজবংশের নাম, যেখান থেকে এক নারী – রাণী ভবানী – সমগ্র বাংলার “অর্ধবঙ্গেশ্বরী” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

নাটোর রাজবংশের সূচনা: অষ্টাদশ শতকের শুরুতে নাটোর রাজবংশের যাত্রা শুরু হয়। ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে পরগণা বানগাছির জমিদার গণেশ রায় ও ভবানীচরণ চৌধুরী রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হয়ে চাকরিচ্যুত হন। তাঁদের জমিদারি কেড়ে নিয়ে দেওয়ান রঘুনন্দন তাঁর ভাই রামজীবনের নামে বন্দোবস্ত নেন। এই রামজীবনই ছিলেন নাটোর রাজবংশের প্রথম রাজা।

রাজা রামজীবন ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে) জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৭৩৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর নিজ সন্তান না থাকায় জীবদ্দশায় এক পুত্র দত্তক নেন—রামকান্ত।

রাণী ভবানীর আগমন:১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামজীবনের দত্তকপুত্র রামকান্তের সঙ্গে বিয়ে হয় রাণী ভবানীর। রাজা রামকান্তের মৃত্যুর পর ১৭৪৮ সালে নবাব আলীবর্দী খাঁ রাণী ভবানীর হাতে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন।

রাণী ভবানীর জন্ম ১৭২৩ সালে বগুড়া জেলার আদমদিঘি থানার ছাতিয়ানগ্রাম গ্রামে। তাঁর পিতা আত্মারাম চৌধুরী ও মাতা জয়দুর্গা দেবী। অল্প বয়সেই তিনি রাজবংশের বধূ হিসেবে নাটোরে আসেন।

অর্ধবঙ্গেশ্বরী রাণী ভবানী: রাণী ভবানীর রাজত্বকালে নাটোর রাজবাড়ির প্রভাব বিস্তৃত হয় এক বিশাল অঞ্চলে। তাঁর জমিদারি ছড়িয়ে ছিল বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও মালদহ পর্যন্ত।

ইংরেজ লেখক হলওয়েলের হিসাবে, তাঁর জমিদারি থেকে বার্ষিক রাজস্ব আয় হতো প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা, যা তৎকালীন সময়ের এক বিরাট অঙ্ক। দক্ষ প্রশাসন, প্রজাহিতৈষী মনোভাব ও দানশীলতার কারণে প্রজারা তাঁকে ভালোবেসে “অর্ধবঙ্গেশ্বরী” নামে অভিহিত করেছিল।

প্রজাদের কল্যাণে দানশীল রাণী: রাণী ভবানীর জীবনযাপন ছিল অনাড়ম্বর, কিন্তু সমাজসেবায় তাঁর দৃষ্টান্ত অনন্য। তিনি শত শত মন্দির, অতিথিশালা ও রাস্তা নির্মাণ করেন। প্রজাদের জন্য পুকুর খনন করে পানীয় জলের ব্যবস্থা করেন এবং শিক্ষা বিস্তারে অনুদান প্রদান করেন।

১৭৫৩ সালে তিনি কাশীতে (বর্তমান বারাণসী) ভবানীশ্বর শিব ও দুর্গাবাড়ী, দুর্গাকুণ্ড ও কুরুক্ষেত্রতলা নামক পবিত্র স্থান নির্মাণ করেন। তাঁর উদ্যোগেই হাওড়া থেকে কাশী পর্যন্ত দীর্ঘ সড়কপথ নির্মিত হয়, যা তখন পরিচিত ছিল “রাণী ভবানী রোড” বা “বেনারস রোড” নামে।

ধর্মীয় অবদান ও দেবোত্তর সম্পত্তি: বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার ভবানীপুর শক্তিপীঠ উন্নয়নে রাণী ভবানীর অবদান আজও স্মরণীয়। কথিত আছে, তিনি প্রতি বছর দু’বার হাতি বহর নিয়ে ভবানীপুরে যেতেন।

পাকিস্তান আমলে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও রাণী ভবানী স্টেটের উত্তরাধিকারীরা ২৬২ একর জমি দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে ভবানীপুর শক্তিপীঠের নামে দানপত্রে নিবন্ধন করে দেন। বর্তমানে ঐ জমির একটি বড় অংশ প্রভাবশালী মহলের দখলে চলে গেছে, যার পুনরুদ্ধারে আদালতে একাধিক মামলা চলছে।

তারাপীঠে অবদান ও বামাক্ষ্যাপার নিয়োগ: বীরভূম জেলার বিখ্যাত তারাপীঠ মন্দিরও তাঁর জমিদারির অন্তর্গত ছিল। ভগ্নপ্রায় অবস্থায় থাকা মন্দিরটি তিনি পুনর্নির্মাণ করেন এবং কিংবদন্তি সাধক বামাক্ষ্যাপাকে মন্দিরের পুরোহিত হিসেবে নিয়োগ দেন।

রাণী ভবানীর রাজবাড়ি, স্থাপত্য ও ঐতিহ্য: নাটোর রাজবাড়ি নির্মাণ শুরু হয় ১৭০৬-১৭১০ সালের মধ্যে। রাজবাড়ির আয়তন প্রায় ১২০ একর, যেখানে ছোট-বড় ৮টি ভবন, ৭টি পুকুর, এবং দুটি স্তরের বেষ্টনী প্রাচীর রয়েছে।

রাজবাড়ি বিভক্ত দুই ভাগে—বড় তরফ ও ছোট তরফ। এখানকার প্রধান মন্দিরগুলো হলো শ্যামসুন্দর মন্দির, আনন্দময়ী কালিবাড়ি ও তারকেশ্বর শিবমন্দির।

রাজবংশের রাজধানী স্থাপনের জন্য রামজীবন ভাতঝাড়ার বিল এলাকা নির্বাচন করেন, যা পরবর্তীতে “নাট্যপুর” নাম ধারণ করে “নাটোর” নামে পরিচিত হয়।

জীবনের শেষ অধ্যায়: দত্তক পুত্র রামকৃষ্ণের হাতে জমিদারি দায়িত্ব অর্পণ করে রাণী ভবানী মুর্শিদাবাদ জেলার বড়নগরে চলে আসেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ভাগীরথী নদীর তীরে তিনি নির্মাণ করেন ১০০টি শিবমন্দির, যার কিছু আজও টিকে আছে।

তাঁর মৃত্যুর পর ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁর রংপুরের জমিদারি দখল করেন। দীর্ঘ ও কর্মবহুল জীবনের পর রাণী ভবানী ১৮০২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, ৭৯ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।

বর্তমান অবস্থা: নাটোর রাজবাড়ি আজ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও পর্যটন স্থাপনা। ১৯৮৬ সাল থেকে রাজবাড়ির পুরো এলাকা জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে “রাণী ভবানী কেন্দ্রীয় উদ্যান ও যুবপার্ক” নামে পরিচালিত হচ্ছে।

রাণী ভবানী কেবল নাটোর বা রাজশাহীর ইতিহাসে নয়, সমগ্র বাংলার ইতিহাসে এক আলোকবর্তিকা—যিনি প্রমাণ করেছিলেন, নারীর নেতৃত্বও রাজনীতি ও প্রশাসনে সমান সফল হতে পারে। তাঁর স্মৃতি, দানশীলতা ও প্রজাহিতৈষী মনোভাব আজও বাংলার মাটিতে কিংবদন্তি হয়ে আছে।