img

আত্মবিশ্বাসের পুনর্জাগরণ

প্রকাশিত :  ০৯:২৬, ০১ অক্টোবর ২০২৫

আত্মবিশ্বাসের পুনর্জাগরণ


\"✍️\" রেজুয়ান আহম্মেদ
রাত দশটা। ঢাকার বেইলি রোডের ছোট্ট এক পুরনো ফ্ল্যাটে গভীর নিস্তব্ধতা। রাফি বসে আছে তার ছোট্ট ঘরে। টেবিলজুড়ে ছড়িয়ে আছে কয়েকটি আবেদনপত্রের অনুলিপি, কিছু অমীমাংসিত বিল, আর ল্যাপটপের সেই ফাঁকা ইনবক্স—যেখানে প্রতি মুহূর্তে সে যেন এক অনিবার্য ঘোষণার অপেক্ষায়: “আপনার আবেদন গৃহীত হয়নি।”
বছরখানেক আগেও জীবনটা চলছিল অন্য ছন্দে। বহুজাতিক সংস্থায় মিড-লেভেল ম্যানেজার রাফি—সম্মানজনক বেতন, কর্মব্যস্ত দিন আর সহকর্মীদের উষ্ণ আড্ডা—সব মিলিয়ে জীবন চলছিল মসৃণ গতিতে। হঠাৎ একদিন কোম্পানির আর্থিক সংকটের অজুহাতে চাকরি চলে গেল। সেই দিনটিই যেন তার জীবন থেকে প্রধান চালিকাশক্তি ছিনিয়ে নিল।
রাফি খাটে হেলান দিয়ে জানালার বাইরে তাকায়। মৃদু হাওয়া বইছে, তবু বুকের ভেতরটা ভারী, শ্বাসরুদ্ধ। মনে হয়, পৃথিবীর সমস্ত গতি, সমস্ত শব্দ তার জন্য থমকে গেছে। ভেতরের এক শূন্যতা তাকে ধীরে ধীরে গিলে খাচ্ছে।
— “আমি কী ভুল করলাম? এত পরিশ্রম, এত সময় দিলাম, তবু কেন?” প্রশ্নগুলো মস্তিষ্কে বারবার আছড়ে পড়ছে।
পাশের ঘরে স্ত্রী মিতু চুপচাপ বসে আছেন। ঘরের প্রতিটি কোণ যেন এই ভারী পরিবেশের নীরব সাক্ষী। সন্তানের স্কুলের ফি, মাসের ভাড়া, বাজারের খরচ—সংসারের এই বোঝা প্রতিদিন আরও বেশি করে চেপে বসছে।
রাফি একসময়ে উঠে দাঁড়াল। বুকের অস্থিরতায় ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করল। ক্রমেই মনে হচ্ছে, নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ তার মুঠো থেকে ফসকে যাচ্ছে।
সে আপন মনে বিড়বিড় করে—
— “আমার মতো অভিজ্ঞ মানুষ যদি কাজ না পায়, তবে আমার কি আদৌ কোনো মূল্য আছে?”
এই প্রশ্নটাই তার ভেতরের সেই সমালোচকের কণ্ঠস্বর, যে কোনোভাবেই থামে না। যে ফিসফিস করে বলে: “তুমি ব্যর্থ, তুমি অক্ষম, তোমার চেষ্টা কোনোদিন ফল দেবে না।” এ যেন তার ভেতরে জন্ম নেওয়া এক অদৃশ্য শত্রু।
ফোনে এল পুরোনো সহকর্মীর ফেসবুক নোটিফিকেশন—নতুন চাকরির ছবি, অফিস ট্যুর, প্রাণবন্ত হাসি। রাফি ফোনটা নামিয়ে রাখল। বুক চিরে ঈর্ষা, হীনমন্যতা আর গভীর হতাশা এক অদ্ভুত যন্ত্রণার জন্ম দিল।
— “আমার জীবনটা এমন হতে পারত না? আমি কেন পিছিয়ে গেলাম?” আক্ষেপ তার কণ্ঠনালী চেপে ধরল।
ঘরের ঘড়ি সেকেন্ড গুনছে। অথচ রাফির কাছে সময় যেন স্থবির। এই দুশ্চিন্তা তাকে অতীত আর ভবিষ্যতের মাঝে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। মনে হয়—“আগেরবার ঠিকমতো পারফর্ম করিনি বলেই চাকরি গেছে।” সেই অপরাধবোধের পাশে জন্ম নেয় ভবিষ্যতের ভয়—“নিশ্চয়ই আর কিছু হবে না, আমি আর উঠে দাঁড়াতে পারব না।”
বর্তমান তার কাছে এক অচেনা, শূন্য গহ্বর।
বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে পরিবারের চিন্তিত মুখ। মেয়ে একদিন স্কুল থেকে ফিরে বলেছিল, “আব্বু, তুমি এখন অফিসে যাও না কেন?” সে কোনো উত্তর দিতে পারেনি; বুকের ভেতর হাহাকার জমে উঠেছিল। আজও সেই প্রশ্ন যেন তাকে বিঁধে যায়। এক অদ্ভুত অসহায়তা—তার সমস্ত শ্রম, সমস্ত সামর্থ্য যেন এক অচল দেয়ালের সামনে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
অন্ধকার এভাবেই তার জীবনে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে। কাল পর্যন্ত যে পৃথিবী তার হাতের মুঠোয় ছিল, আজ মনে হচ্ছে—সে নিজেই পৃথিবীর কাছে অসহায়।
সকালের আলো জানালার ফাঁক গলে ঘরে ঢুকলেও রাফির চোখে কোনো দীপ্তি নেই। ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছে, কিন্তু তার জীবনের কাঁটা যেন থেমে আছে। অফিসের সহকর্মীরা হয়তো এখন সাপ্তাহিক মিটিংয়ে ব্যস্ত, নতুন প্রজেক্টের পরিকল্পনা করছে, কেউবা কফি কর্নারে আড্ডা দিচ্ছে। আর রাফি?
সে ফ্ল্যাটের ছোট্ট টেবিলে বসে আছে, যেখানে ঠাণ্ডা ভাত-ডাল পড়ে আছে। মিতু নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কথার বদলে তার চোখে এখন অভিযোগের ক্লান্তি। সংসারের হিসেব প্রতিদিনই এক অমীমাংসিত প্রশ্ন হয়ে আসে।
— “তুমি আবার কবে চেষ্টা করবে? এতগুলো আবেদন করলে, কিন্তু কোনো খবর তো আসছে না…” মিতুর কণ্ঠে কোনো আক্রোশ নেই, আছে শুধু আশা হারানোর নিস্তেজতা।
রাফি নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। একসময়ের প্রাণবন্ত মানুষটা এখন জবাব দিতে চায় না। ভেতরের কণ্ঠস্বরই উত্তর দেয়: “আমি কি আদৌ কিছু করতে পারি? আমার সব চেষ্টা কি বৃথা?”
কর্মপরিচয়—যা ছিল তার গর্ব, শক্তি, আত্মমর্যাদার ভিত্তি—আজ সেটাই ভেঙে পড়েছে। গতকাল পর্যন্ত যাদের সামনে মাথা উঁচু করে বলত, “আমি অমুক প্রতিষ্ঠানে কাজ করি,” আজ তাদের চোখে চোখ রাখার সাহস নেই।
বন্ধুরা ফোন করলে রাফি সত্যিটা বলতে পারে না। মুখে হাসি টেনে বলে, “ভালো আছি, নতুন কিছু খুঁজছি।” কিন্তু ফোন কেটে দেওয়ার পর নিজেকে ভাঙা আয়নার মতো মনে হয়—যেখানে মুখোশের আড়ালে শুধু ভাঙাচোরা টুকরো দেখা যায়।
একদিন পুরোনো সহকর্মীর সঙ্গে রাস্তায় হঠাৎ দেখা। সে উজ্জ্বল মুখে বলল, “দোস্ত, আমার পদোন্নতি হয়েছে! এখন আমি টিম লিডার!” রাফির ঠোঁট কেঁপে উঠল, জোর করে অভিনন্দন জানাল। কিন্তু মনে হলো, কেউ যেন বুকের ভেতর ছুরি বসিয়ে দিল। সেই মুহূর্তে সে বুঝল—সে কেবল চাকরি হারায়নি, হারিয়েছে সামাজিক অবস্থান, সম্মান আর আত্মবিশ্বাসের স্তম্ভ।
সেই শীতল এক সকালে রাফি জানালার পর্দা সরাল। বাইরে নরম রোদ ঝলমল করছে। অনেক দিন পর মনে হলো—এই আলো কেবল পৃথিবীর জন্য নয়, তার ভেতরেও এক নতুন সকাল এসেছে।
চা খেতে খেতে ল্যাপটপ খুলল, চাকরির বিজ্ঞাপন দেখতে লাগল। কিন্তু আজ তার ভঙ্গি ভিন্ন। প্রতিটি ব্যর্থতা যা আগে তাকে আঘাত করত, আজ সে নিজেকে বলল: “হয়তো এটাতে হবে না, কিন্তু অন্য কোথাও নিশ্চয়ই দরজা খুলবে। আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব।”
সে ভাবল, কেন জীবনের নিয়ন্ত্রণ কেবল একটি চাকরির হাতে তুলে দেবে? কেন নতুন কিছু শুরু করবে না? মনে পড়ল, বিশ্ববিদ্যালয়ে সে বন্ধুদের নিয়ে ছোট্ট টিউশনি সেন্টার চালাত। তার সাংগঠনিক দক্ষতার সবাই প্রশংসা করত। সেই দক্ষতাকে আবার কাজে লাগাবে না কেন?
রাফি একটি খাতা বের করল। নিজের পরিকল্পনা লিখতে শুরু করল—
১. নতুন চাকরির চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
২. পাশাপাশি তরুণদের জন্য অনলাইনে ইংরেজি ও আইটির একটি কোর্স শুরু করা।
৩. প্রতিদিন অন্তত আধঘণ্টা আত্ম-অনুশীলন—ধ্যান, আত্ম-সহানুভূতির চর্চা।
মিতু খাতার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “এই তো! তোমাকে আবার আগের রাফির মতো লাগছে।”
তার চোখে ভরসার আলো, যা রাফির ভেতরে সাহস জোগাল।
কয়েকদিন পর রাফি সোশ্যাল মিডিয়ায় কোর্সের বিজ্ঞাপন দিল। অবাক হয়ে দেখল, অনেকেই যোগাযোগ করেছে। প্রথম ক্লাসের দিন বুক ধড়ফড় করলেও ছাত্রদের আগ্রহ দেখে মনে হলো—হ্যাঁ, সে এখনও কিছু দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
প্রথম ক্লাস শেষ হতেই ভেতর এক অদ্ভুত আনন্দ বয়ে গেল। মনে হলো, সে এখনও জীবনের খেলায় অংশ নিচ্ছে, হারিয়ে যায়নি।
সন্ধ্যায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাফি আকাশের দিকে তাকাল। দীর্ঘদিন যে চাঁদকে নিঃসঙ্গতার প্রতীক মনে করত, আজ তা আশার প্রতীক হয়ে উঠল।
সে মনে মনে বলল: “হয়তো আমি আগের চাকরির মানুষ নই। হয়তো জীবনটা অন্য পথে আমাকে ডাকছে। কিন্তু আমি ভেঙে পড়িনি, আমি আবার দাঁড়াতে শিখেছি। আর এটাই আমার সত্যিকারের জয়।”
মেয়ে দৌড়ে এসে হাত ধরল। “আব্বু, তুমি আবার হাসছো কেন?”
রাফি মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “কারণ আমি নতুন করে শুরু করেছি।”
সেদিন রাতে শোয়ার সময় তার ভেতরের সমালোচকের কণ্ঠস্বর যেন সম্পূর্ণ নীরব। জায়গা করে নিয়েছিল এক নতুন, শান্ত কণ্ঠ: “তুমি যথেষ্ট। তুমি হেরে যাওনি, তুমি শিখছো। আর এই শিক্ষাই তোমার জয়।”
এভাবেই অন্ধকারের ভেতর থেকে জন্ম নিল এক নতুন রাফি—যিনি আর কেবল হারানো চাকরির পরিচয়ে আটকে নেই, বরং নিজের ভেতরের আলোয় নতুন এক যাত্রা শুরু করেছেন।
-সমাপ্ত-
img

বাংলাদেশের ইতিহাসে রাণী ভবানী ও নাটোর রাজবাড়ী: অর্ধবঙ্গেশ্বরীর গৌরবগাথা

প্রকাশিত :  ০৯:২৫, ০৪ নভেম্বর ২০২৫

সংগ্রাম দত্ত

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত নাটোর জেলা একসময় ছিল রাজকীয় ঐশ্বর্যের কেন্দ্রস্থল। এই জেলার সদর উপজেলায় অবস্থিত বিখ্যাত রাণী ভবানী রাজবাড়ী, বাংলার ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়ের সাক্ষী। জমিদারি প্রথার উত্থান-পতনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই রাজবংশের নাম, যেখান থেকে এক নারী – রাণী ভবানী – সমগ্র বাংলার “অর্ধবঙ্গেশ্বরী” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

নাটোর রাজবংশের সূচনা: অষ্টাদশ শতকের শুরুতে নাটোর রাজবংশের যাত্রা শুরু হয়। ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে পরগণা বানগাছির জমিদার গণেশ রায় ও ভবানীচরণ চৌধুরী রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হয়ে চাকরিচ্যুত হন। তাঁদের জমিদারি কেড়ে নিয়ে দেওয়ান রঘুনন্দন তাঁর ভাই রামজীবনের নামে বন্দোবস্ত নেন। এই রামজীবনই ছিলেন নাটোর রাজবংশের প্রথম রাজা।

রাজা রামজীবন ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে) জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৭৩৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর নিজ সন্তান না থাকায় জীবদ্দশায় এক পুত্র দত্তক নেন—রামকান্ত।

রাণী ভবানীর আগমন:১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামজীবনের দত্তকপুত্র রামকান্তের সঙ্গে বিয়ে হয় রাণী ভবানীর। রাজা রামকান্তের মৃত্যুর পর ১৭৪৮ সালে নবাব আলীবর্দী খাঁ রাণী ভবানীর হাতে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন।

রাণী ভবানীর জন্ম ১৭২৩ সালে বগুড়া জেলার আদমদিঘি থানার ছাতিয়ানগ্রাম গ্রামে। তাঁর পিতা আত্মারাম চৌধুরী ও মাতা জয়দুর্গা দেবী। অল্প বয়সেই তিনি রাজবংশের বধূ হিসেবে নাটোরে আসেন।

অর্ধবঙ্গেশ্বরী রাণী ভবানী: রাণী ভবানীর রাজত্বকালে নাটোর রাজবাড়ির প্রভাব বিস্তৃত হয় এক বিশাল অঞ্চলে। তাঁর জমিদারি ছড়িয়ে ছিল বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও মালদহ পর্যন্ত।

ইংরেজ লেখক হলওয়েলের হিসাবে, তাঁর জমিদারি থেকে বার্ষিক রাজস্ব আয় হতো প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা, যা তৎকালীন সময়ের এক বিরাট অঙ্ক। দক্ষ প্রশাসন, প্রজাহিতৈষী মনোভাব ও দানশীলতার কারণে প্রজারা তাঁকে ভালোবেসে “অর্ধবঙ্গেশ্বরী” নামে অভিহিত করেছিল।

প্রজাদের কল্যাণে দানশীল রাণী: রাণী ভবানীর জীবনযাপন ছিল অনাড়ম্বর, কিন্তু সমাজসেবায় তাঁর দৃষ্টান্ত অনন্য। তিনি শত শত মন্দির, অতিথিশালা ও রাস্তা নির্মাণ করেন। প্রজাদের জন্য পুকুর খনন করে পানীয় জলের ব্যবস্থা করেন এবং শিক্ষা বিস্তারে অনুদান প্রদান করেন।

১৭৫৩ সালে তিনি কাশীতে (বর্তমান বারাণসী) ভবানীশ্বর শিব ও দুর্গাবাড়ী, দুর্গাকুণ্ড ও কুরুক্ষেত্রতলা নামক পবিত্র স্থান নির্মাণ করেন। তাঁর উদ্যোগেই হাওড়া থেকে কাশী পর্যন্ত দীর্ঘ সড়কপথ নির্মিত হয়, যা তখন পরিচিত ছিল “রাণী ভবানী রোড” বা “বেনারস রোড” নামে।

ধর্মীয় অবদান ও দেবোত্তর সম্পত্তি: বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার ভবানীপুর শক্তিপীঠ উন্নয়নে রাণী ভবানীর অবদান আজও স্মরণীয়। কথিত আছে, তিনি প্রতি বছর দু’বার হাতি বহর নিয়ে ভবানীপুরে যেতেন।

পাকিস্তান আমলে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও রাণী ভবানী স্টেটের উত্তরাধিকারীরা ২৬২ একর জমি দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে ভবানীপুর শক্তিপীঠের নামে দানপত্রে নিবন্ধন করে দেন। বর্তমানে ঐ জমির একটি বড় অংশ প্রভাবশালী মহলের দখলে চলে গেছে, যার পুনরুদ্ধারে আদালতে একাধিক মামলা চলছে।

তারাপীঠে অবদান ও বামাক্ষ্যাপার নিয়োগ: বীরভূম জেলার বিখ্যাত তারাপীঠ মন্দিরও তাঁর জমিদারির অন্তর্গত ছিল। ভগ্নপ্রায় অবস্থায় থাকা মন্দিরটি তিনি পুনর্নির্মাণ করেন এবং কিংবদন্তি সাধক বামাক্ষ্যাপাকে মন্দিরের পুরোহিত হিসেবে নিয়োগ দেন।

রাণী ভবানীর রাজবাড়ি, স্থাপত্য ও ঐতিহ্য: নাটোর রাজবাড়ি নির্মাণ শুরু হয় ১৭০৬-১৭১০ সালের মধ্যে। রাজবাড়ির আয়তন প্রায় ১২০ একর, যেখানে ছোট-বড় ৮টি ভবন, ৭টি পুকুর, এবং দুটি স্তরের বেষ্টনী প্রাচীর রয়েছে।

রাজবাড়ি বিভক্ত দুই ভাগে—বড় তরফ ও ছোট তরফ। এখানকার প্রধান মন্দিরগুলো হলো শ্যামসুন্দর মন্দির, আনন্দময়ী কালিবাড়ি ও তারকেশ্বর শিবমন্দির।

রাজবংশের রাজধানী স্থাপনের জন্য রামজীবন ভাতঝাড়ার বিল এলাকা নির্বাচন করেন, যা পরবর্তীতে “নাট্যপুর” নাম ধারণ করে “নাটোর” নামে পরিচিত হয়।

জীবনের শেষ অধ্যায়: দত্তক পুত্র রামকৃষ্ণের হাতে জমিদারি দায়িত্ব অর্পণ করে রাণী ভবানী মুর্শিদাবাদ জেলার বড়নগরে চলে আসেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ভাগীরথী নদীর তীরে তিনি নির্মাণ করেন ১০০টি শিবমন্দির, যার কিছু আজও টিকে আছে।

তাঁর মৃত্যুর পর ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁর রংপুরের জমিদারি দখল করেন। দীর্ঘ ও কর্মবহুল জীবনের পর রাণী ভবানী ১৮০২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, ৭৯ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।

বর্তমান অবস্থা: নাটোর রাজবাড়ি আজ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও পর্যটন স্থাপনা। ১৯৮৬ সাল থেকে রাজবাড়ির পুরো এলাকা জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে “রাণী ভবানী কেন্দ্রীয় উদ্যান ও যুবপার্ক” নামে পরিচালিত হচ্ছে।

রাণী ভবানী কেবল নাটোর বা রাজশাহীর ইতিহাসে নয়, সমগ্র বাংলার ইতিহাসে এক আলোকবর্তিকা—যিনি প্রমাণ করেছিলেন, নারীর নেতৃত্বও রাজনীতি ও প্রশাসনে সমান সফল হতে পারে। তাঁর স্মৃতি, দানশীলতা ও প্রজাহিতৈষী মনোভাব আজও বাংলার মাটিতে কিংবদন্তি হয়ে আছে।