অপ্রকাশিত ভালোবাসা
রেজুয়ান আহম্মেদ
প্রজ্ঞার বয়স মাত্র ষোল বছর। সে ছিল একটি সাধারণ কিশোরী মেয়ে, যে কিনা বাবা-মার সাথে শহরের ছোট্ট এক কোণে নিজের পৃথিবী গড়ে তুলেছিল। তার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে স্কুল, পড়াশোনা, আর বইয়ের মধ্যে। কিন্তু তার মনের ভেতরে ছিল এক অন্যরকম রঙিন জগত। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে প্রজ্ঞা ছোট্ট ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দূরের আকাশে তাকিয়ে থাকতো, যেন কিছু একটা খুঁজে বেড়াতো। তবে সেই আকাশের চেয়েও বেশি আকর্ষণ ছিল তার জন্য পাশের বাড়ির যুবক অর্ণব চৌধুরী।
অর্ণব ছিল ত্রিশ বছরের একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার। সুদর্শন, মার্জিত এবং আত্মবিশ্বাসী অর্ণবের প্রতিটি চলাফেরা ছিল প্রজ্ঞার চোখে আদর্শের মতো। প্রথম যখন প্রজ্ঞা অর্ণবকে দেখেছিল, তার মনে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, এই মানুষটি যেন আলাদা। কিশোরী মন অর্ণবের প্রতি এক অজানা টান অনুভব করেছিল। সে জানতো, এই অনুভূতি তার জন্য নতুন, তবে একই সাথে ভয়ও লাগছিল। কেমন করে একজন কিশোরী মেয়ে এমন একজন যুবকের প্রতি এই অজানা ভালোবাসা পোষণ করতে পারে?
প্রথম প্রথম প্রজ্ঞা নিজের মনের এই অনুভূতিকে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সে বুঝতে পারলো, তার এই একতরফা ভালোবাসা দিন দিন বেড়েই চলেছে। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় যখন সে অর্ণবকে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে দেখতো, তার হৃদয়ে যেন ঢেউ উঠতো। সে দূর থেকে অর্ণবকে চেয়ে চেয়ে দেখতো, কিন্তু কখনো সামনে গিয়ে কথা বলার সাহস করতে পারতো না। যেন তার নিজের ভালোবাসা তার কাছেই ছিল অচেনা, অধরা।
প্রজ্ঞার দিনগুলো কাটছিল এই চুপচাপ ভালোবাসার মধ্যে। অর্ণবের দৃষ্টি একদিন প্রজ্ঞার দিকে গেলে, তার মন যেন আনন্দে নেচে উঠতো। আবার যখন অর্ণব তাকে না দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যেত, তখন মন খারাপ হয়ে যেত। একের পর এক দিন কাটছিল, আর প্রজ্ঞা প্রতিদিন অর্ণবকে দূর থেকে দেখে নিজের ভালোবাসা লুকিয়ে রাখতো।
এভাবে কেটে গেল কয়েক মাস। প্রজ্ঞা প্রতিদিন নিজের মনের কথা ডায়েরিতে লিখে রাখতো। সেখানে সে অর্ণবের প্রতি তার গভীর ভালোবাসার কথা তুলে ধরতো। "অর্ণব, তুমি কি জানো, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি?" এই কথাগুলো ডায়েরির পাতায় লেখা থাকলেও, অর্ণবের কাছে প্রকাশ করতে পারা একেবারেই অসম্ভব ছিল। প্রজ্ঞা জানতো, তার এই ভালোবাসা সমাজের চোখে অসম্ভব। বয়সের এত ব্যবধান, আর অর্ণবের মতো একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির কাছে তার মতো একটি কিশোরী মেয়ের ভালোবাসা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।
এভাবেই চলছিল প্রজ্ঞার একপাক্ষিক ভালোবাসার গল্প। কিন্তু হঠাৎ একদিন সে শুনতে পেল, অর্ণব চাকরির কারণে অন্য শহরে চলে যাচ্ছে। এই খবর শুনে প্রজ্ঞার পুরো পৃথিবী যেন থমকে গেল। অর্ণব শহর ছেড়ে চলে যাবে? আর কখনো কি সে তাকে দেখতে পাবে না? এই চিন্তা প্রজ্ঞার হৃদয়ে শূন্যতার সৃষ্টি করলো। সে কি কখনোই তার ভালোবাসার কথা বলতে পারবে না?
অর্ণবের চলে যাওয়ার দিনটি ছিল একেবারে সাধারণ একটি দিন, কিন্তু প্রজ্ঞার জন্য তা ছিল ভীষণ কষ্টের। সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, আর দেখছিল অর্ণব তার ব্যাগ হাতে নিয়ে গাড়িতে উঠছে। প্রজ্ঞা দূর থেকে তাকিয়ে ছিল, অর্ণবকে কিছু বলতে পারলো না। মনের মধ্যে জমে থাকা হাজারো কথা থাকলেও, তার ঠোঁট থেকে কোনো শব্দ বের হলো না। শুধু মনের ভেতরে একটা গভীর কষ্টের ঢেউ বয়ে গেল।
অর্ণব চলে যাওয়ার পর প্রজ্ঞার জীবন যেন একেবারেই নিঃস্ব হয়ে গেল। প্রতিদিন সেই পুরনো ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সে খালি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো, যেন অর্ণবকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতো। কিন্তু জানতো, সেই ভালোবাসা আর কখনোই ফিরে আসবে না। অর্ণবের স্মৃতি তার হৃদয়ে গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল, যা কখনোই ভোলা সম্ভব নয়।
কিছুদিন পর থেকে প্রজ্ঞার মনের অবস্থা আর আগের মতো ছিল না। সে প্রতিদিন অর্ণবের কথা ভাবতো, কিন্তু তার সাথে আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। একদিন সে তার ডায়েরির পাতাগুলো খুলে বসলো। প্রতিটি পাতায় লেখা ছিল অর্ণবের প্রতি তার একতরফা ভালোবাসার কথা। সে ডায়েরির প্রতিটি লাইন পড়তে পড়তে কাঁদতে লাগলো। তার চোখের পানি ডায়েরির পাতাগুলো ভিজিয়ে দিচ্ছিল, আর সেই সাথে ভিজিয়ে দিচ্ছিল তার মনের গভীর কষ্টগুলো।
প্রজ্ঞা জানতো, তার ভালোবাসা ছিল একেবারেই একতরফা। সে কখনোই এই ভালোবাসার কথা অর্ণবকে বলতে পারেনি, আর কখনোই বলতে পারবে না। কিন্তু তার মনের এক কোণে সবসময়ই অর্ণবের স্মৃতি থাকবে।
এই ভালোবাসা কোনোদিন প্রকাশিত হয়নি, আর হয়তো কোনোদিন হবে না। তবুও প্রজ্ঞার হৃদয়ে সেই অপ্রকাশিত ভালোবাসা আজীবন থেকে যাবে, যা তার জীবনের একান্ত নিজস্ব গল্প হয়ে থাকবে।