img

অপ্রকাশিত ভালোবাসা

প্রকাশিত :  ০৬:৪৫, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ০৮:০৯, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

অপ্রকাশিত ভালোবাসা

রেজুয়ান আহম্মেদ

প্রজ্ঞার বয়স মাত্র ষোল বছর। সে ছিল একটি সাধারণ কিশোরী মেয়ে, যে কিনা বাবা-মার সাথে শহরের ছোট্ট এক কোণে নিজের পৃথিবী গড়ে তুলেছিল। তার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে স্কুল, পড়াশোনা, আর বইয়ের মধ্যে। কিন্তু তার মনের ভেতরে ছিল এক অন্যরকম রঙিন জগত। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে প্রজ্ঞা ছোট্ট ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দূরের আকাশে তাকিয়ে থাকতো, যেন কিছু একটা খুঁজে বেড়াতো। তবে সেই আকাশের চেয়েও বেশি আকর্ষণ ছিল তার জন্য পাশের বাড়ির যুবক অর্ণব চৌধুরী।

অর্ণব ছিল ত্রিশ বছরের একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার। সুদর্শন, মার্জিত এবং আত্মবিশ্বাসী অর্ণবের প্রতিটি চলাফেরা ছিল প্রজ্ঞার চোখে আদর্শের মতো। প্রথম যখন প্রজ্ঞা অর্ণবকে দেখেছিল, তার মনে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, এই মানুষটি যেন আলাদা। কিশোরী মন অর্ণবের প্রতি এক অজানা টান অনুভব করেছিল। সে জানতো, এই অনুভূতি তার জন্য নতুন, তবে একই সাথে ভয়ও লাগছিল। কেমন করে একজন কিশোরী মেয়ে এমন একজন যুবকের প্রতি এই অজানা ভালোবাসা পোষণ করতে পারে?

প্রথম প্রথম প্রজ্ঞা নিজের মনের এই অনুভূতিকে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সে বুঝতে পারলো, তার এই একতরফা ভালোবাসা দিন দিন বেড়েই চলেছে। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় যখন সে অর্ণবকে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে দেখতো, তার হৃদয়ে যেন ঢেউ উঠতো। সে দূর থেকে অর্ণবকে চেয়ে চেয়ে দেখতো, কিন্তু কখনো সামনে গিয়ে কথা বলার সাহস করতে পারতো না। যেন তার নিজের ভালোবাসা তার কাছেই ছিল অচেনা, অধরা।

প্রজ্ঞার দিনগুলো কাটছিল এই চুপচাপ ভালোবাসার মধ্যে। অর্ণবের দৃষ্টি একদিন প্রজ্ঞার দিকে গেলে, তার মন যেন আনন্দে নেচে উঠতো। আবার যখন অর্ণব তাকে না দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যেত, তখন মন খারাপ হয়ে যেত। একের পর এক দিন কাটছিল, আর প্রজ্ঞা প্রতিদিন অর্ণবকে দূর থেকে দেখে নিজের ভালোবাসা লুকিয়ে রাখতো।

এভাবে কেটে গেল কয়েক মাস। প্রজ্ঞা প্রতিদিন নিজের মনের কথা ডায়েরিতে লিখে রাখতো। সেখানে সে অর্ণবের প্রতি তার গভীর ভালোবাসার কথা তুলে ধরতো। "অর্ণব, তুমি কি জানো, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি?" এই কথাগুলো ডায়েরির পাতায় লেখা থাকলেও, অর্ণবের কাছে প্রকাশ করতে পারা একেবারেই অসম্ভব ছিল। প্রজ্ঞা জানতো, তার এই ভালোবাসা সমাজের চোখে অসম্ভব। বয়সের এত ব্যবধান, আর অর্ণবের মতো একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির কাছে তার মতো একটি কিশোরী মেয়ের ভালোবাসা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।

এভাবেই চলছিল প্রজ্ঞার একপাক্ষিক ভালোবাসার গল্প। কিন্তু হঠাৎ একদিন সে শুনতে পেল, অর্ণব চাকরির কারণে অন্য শহরে চলে যাচ্ছে। এই খবর শুনে প্রজ্ঞার পুরো পৃথিবী যেন থমকে গেল। অর্ণব শহর ছেড়ে চলে যাবে? আর কখনো কি সে তাকে দেখতে পাবে না? এই চিন্তা প্রজ্ঞার হৃদয়ে শূন্যতার সৃষ্টি করলো। সে কি কখনোই তার ভালোবাসার কথা বলতে পারবে না?

অর্ণবের চলে যাওয়ার দিনটি ছিল একেবারে সাধারণ একটি দিন, কিন্তু প্রজ্ঞার জন্য তা ছিল ভীষণ কষ্টের। সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, আর দেখছিল অর্ণব তার ব্যাগ হাতে নিয়ে গাড়িতে উঠছে। প্রজ্ঞা দূর থেকে তাকিয়ে ছিল, অর্ণবকে কিছু বলতে পারলো না। মনের মধ্যে জমে থাকা হাজারো কথা থাকলেও, তার ঠোঁট থেকে কোনো শব্দ বের হলো না। শুধু মনের ভেতরে একটা গভীর কষ্টের ঢেউ বয়ে গেল।

অর্ণব চলে যাওয়ার পর প্রজ্ঞার জীবন যেন একেবারেই নিঃস্ব হয়ে গেল। প্রতিদিন সেই পুরনো ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সে খালি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো, যেন অর্ণবকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতো। কিন্তু জানতো, সেই ভালোবাসা আর কখনোই ফিরে আসবে না। অর্ণবের স্মৃতি তার হৃদয়ে গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল, যা কখনোই ভোলা সম্ভব নয়।

কিছুদিন পর থেকে প্রজ্ঞার মনের অবস্থা আর আগের মতো ছিল না। সে প্রতিদিন অর্ণবের কথা ভাবতো, কিন্তু তার সাথে আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। একদিন সে তার ডায়েরির পাতাগুলো খুলে বসলো। প্রতিটি পাতায় লেখা ছিল অর্ণবের প্রতি তার একতরফা ভালোবাসার কথা। সে ডায়েরির প্রতিটি লাইন পড়তে পড়তে কাঁদতে লাগলো। তার চোখের পানি ডায়েরির পাতাগুলো ভিজিয়ে দিচ্ছিল, আর সেই সাথে ভিজিয়ে দিচ্ছিল তার মনের গভীর কষ্টগুলো।

প্রজ্ঞা জানতো, তার ভালোবাসা ছিল একেবারেই একতরফা। সে কখনোই এই ভালোবাসার কথা অর্ণবকে বলতে পারেনি, আর কখনোই বলতে পারবে না। কিন্তু তার মনের এক কোণে সবসময়ই অর্ণবের স্মৃতি থাকবে।

এই ভালোবাসা কোনোদিন প্রকাশিত হয়নি, আর হয়তো কোনোদিন হবে না। তবুও প্রজ্ঞার হৃদয়ে সেই অপ্রকাশিত ভালোবাসা আজীবন থেকে যাবে, যা তার জীবনের একান্ত নিজস্ব গল্প হয়ে থাকবে।

img

অমৃত রসে মৃগতৃষ্ণা প্রেমে

প্রকাশিত :  ১০:২২, ২৪ নভেম্বর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১০:৫২, ২৪ নভেম্বর ২০২৪

প্রাকৃতজ শামিমরুমি টিটন 


আলোনিশি খেলে চলে দিবারাত জলের খেলা

জলের খোলসে ভ্রূণজল বেঁধেছে বাসা—

দুলে ওঠে ঊ‍র্মির ঢেউ বুকে সিন্ধুব্যাথা

পলেপলে রচে ধরা প্রেমাখরে অমরাবতী

লিখে রাখে রসাদেহে আদিজল অন্তরালে

সত্য-শুদ্ধ প্রেমের কথা, যা হয়নি বলা....।


সুপ্ত-গুপ্ত জ্যোতি অমৃত প্রেমে মৃত্যুর সুধারস!

তুমি ছিলে প্রেম আরও বাস্তব—পৃথিবী প্রেমের মতো

দিবানিশি শেষে, ডুবে গেছি প্রগাঢ় নিবিষ্ট ধ্রুবলোকে

দেখেছি তোমারে নিভৃত খ-চোখে—খচিত খ-জল ভ্রূণ

অনিমেষ ধ্রুব! খগের মতো চেয়ে-চেয়ে দেখেছি কেবল

তুমি দিনেদিনে উর্বরা যৌবনে চিরায়ত সুধারস!

স্ফীত কল্লোল রমণীয় রমণ ভরা বর্ষার জলে—

ষড়ঋতু খেলে প্রেমের জলকেলী তোমার ষড়াঙ্গ দেহে!


ধরা-ধড় প্রেমে অনন্ত ধারায় ফুটেছে জীবন ফল!

রজঋতু রসে কোরাঙ্কিত কেশর সুবাসিত মধুময়

তোমার পদ্ম-নাভিতে গজানিয়া কদম নাগেশ্বর!

অঙ্কুরিত পুটে-নক্ষত্র ভ্রূণ-কোঁড়ে শাপলা-শালুক;

বিকশিত তোমার প্রশস্থ পয়োধ কলমী কচুরী ফুল

ঝিলমিল ঝিলে স্বপ্নিল প্রেমের স্রোতে ধরণী ব্যাকুল!


স্নিগ্ধ নরম আলতো তুলতুল ধূলিরেণু ঘাসফুল

লিলি টিউলিপ লাল সূর্য চুমে রক্তজবার ঠোঁটে—

উদয় অস্তে রসাঞ্জন রসা রসালো স্বর্ণলতা,

প্যাঁচিয়ে ধরেছ যথায় উথলিয়া উঠেছে প্রেমের স্রোত

যৌবন জোয়ারে রমণীয় তোমার হরিদ শরীরদেহ—

উর্বরা তত প্রশস্ত গভীর অস্থির সাগরের মতো!...

আদরে আদরে ভরে দিয়েছো তুমি জগৎ-জীবনকুল,

তারার বাসরে তুমি স্বর্ণচাঁপা চন্দ্রের নাকফুল!


ধ্রুপদী দোহিতা প্রেমে পরিপ্লুত ধরা প্রমোদকানন

দেখেছি প্রেমের শিহরনে তোমার দেহের গোলাপ ফুল!

তোমার প্রেমের আচ্ছাদনে প্রিয় স্বর্গ গিয়াছি ভুলে—

দিবানিশি দ্যুতি আলো-অন্ধকারে অতল প্রেমের জ্যোতি

বিম্ব ছায়ায় ধোঁয়াশা কুয়াশায় ধুমকেতু ধুপছায়া—

সজ্জিত দেহ প্রজাপতির মতো অর্কি রঙের বাসর!


কী নিঃশব্দ নীরব ভেসে যায় আবির প্রেমের স্রোত

অন্ধনিশিথে চন্দ্রমুখে দেখি তোমার নগ্ন দেহ—

খেলিতেছ তুমি চন্দ্র কলাবতী অমৃত প্রেমের রসে

বিকশিত তুমি সৌষম্য চির জগৎ-গন্ধা-ফুল

পুষ্পবতীর পরাঙমুখে চেয়ে থাকে নগ্ন পা-দুটি—

শিশিরের মতো চুমু খাই তোমার মধুপ আলতা পায়ে

হেঁটে যায় প্রেম নিশি নগ্ন পায়ে ভোরের শিশির মেখে

আমার হৃদয়ে নিশিভোর তোমার পায়ের নূপুর বাজে!


বুকে মরানদী কেঁদেছিল প্রেমে কী নিঃশব্দ নীরব!

মেঘে ভাসে জল চন্দ্র ডুবজল থাকে না মেঘের বাড়ি

ঘরহারা পাখি কখন কোথা ঘুরে, জানে নাকি প্রেমপাখি?

শূন্য ঘরেতে নির্জর প্রেমের অরূপ বসতবাড়ি—

অমৃত প্রেমের মূর্ছনা বাজায় এক মরমিয়া কবি!

তৃষ্ণা লাগে না মগ্ন মীনজলে, কস্তুরি মৃগনাভে

অথচ, কত কী! বলেছি কামনায়, বাসনার প্রেমজালে

কুহেলী মায়ায় ধোঁয়াশা কুয়াশায় মিছামিছি

ছেঁড়াফাড়া সব বিদীর্ণ স্মৃতি ধূলিকণা উঁইঢিবি—

বিরহ-বিমূঢ় বিবর্ণ মলিন, ধূসর পাণ্ডুলিপি!


প্রতি জনে এক, চেনা অচেনা সবে—লহরি রঙের লীলা,

মিলিতেছে প্রাণে ঐক্যে-একতা নিত্য প্রেমের পথে!

চন্দ্র-সূর্য নক্ষত্র তারা কেউ কাউকে চিনে কী?

চেনাজানা প্রেমে—যে প্রেমিক অচেনা প্রেমে সাজায় বাসর,

জানে কি গ্রহরা? কী নেশায় মত্ত প্রবর ঘূর্ণি-ঘোর—

সদা দিবানিশি কী প্রেম প্রেষণায় মৌন যশঃকীর্তন,

কী তৃষ্ণা প্রেমে আলো-অন্ধকারে—জানে কি জ্যোতির্লোক?

কে জানে তবে? জানে এক প্রেমিক, জানে প্রেমের কারক—

কী মহিমা প্রেমে, কী সৃজনকলায় প্রেম খেলে নিশিদিন!

অধরা মাধুরী, কে বাজায় বাঁশরী প্রেমের কক্ষপথে—

আমি জেগে থাকি প্রেমের-আলোনিশি নিশিভোর!

অথচ, কত কী বিফল বেদনায় বলিয়াছি দিবারাত!

হায়রে জীবন, শূন্য বিভাজনে ভ্রম বিরচন! ওহো!

মায়ায় কায়ায় সহস্র নিশুতি দেখেছি স্বপ্ন কত,

বেঁধেছি অথই স্বপ্নের বাসর, কত কী ঊর্ণাজালে!

ভেঙে গেছে শেষে নিশির শিশিরের মতো পৃথিবীর প্রেম

আলো আর নিশি এই চির খেলায় বাঁচিয়াছি একদিন!

চেয়ে দেখ নিশিভোর আমি চির অণ্ধ শেষে!—


প্রেমের জ্যোতিতে মৃত্যুর ছায়ায় নামে উজাগর রাত

তাই লিখে যাই—হে প্রিয় অনাগত, জীবনের জয়গান;

প্রেমের ধারায় বয়ে যায় অনন্ত চির স্বর্গ সময়!

বলে যাই প্রিয়—বিদূর ছায়াপথে প্রেমের গল্প যত

বেদনা বিধুর কাঙ্ক্ষা নিয়তির নিরত কষ্ট তত!

লোভ-লাভ-দেহে মৃত্যু কাকে বলে? ভয়ভীতি ফেলে

যে খেলায় প্রেমে, জানে সেই প্রেমিক! খুলে যায় মৃত্যুতে

স্বর্গ প্রেমের দ্বার—জীবন দেখে মৃত্যুর-সৌন্দর্য!

যারে মন যারে ময়ূরপঙ্খি-নায়- জ্যোতিষ্ক পথ দেখায়!

অপার প্রেমের রহস্য প্রগাঢ় উলঙ্গ পথের মতো

মৃত্যু শূন্য জগৎ মধুময় মধুর অমৃত প্রেমে—

আহা মায়াময়! মৃগতৃষ্ণা প্রেমে মরে নষ্ট প্রহর;

ফুরায় সময় কাহলী কোলাহলে মিলন-বিরহ প্রেমে

হা হা, হুহুতাশ ফাঁকা শূন্যে পূর্ণ অগ্নি-পবন-জলে

সুপ্ত-গুপ্ত প্রেমের রহস্য আলোক-অন্ধকারে—

চন্দ্রিমা রাতে সাদা ঘোড়ার স্রোত ভেসে যায় দিগন্তে!

সাতটি তারার তিমিরে নিশ্চুপ সপ্ত ভুবন দূর—

অন্ধনিশিতে দুলকী ছুটে যায় কালো ঘোড়ার স্রোত

পৃথিবীর বুকে অন্ধকার ফুঁড়ে নেমে আসে নিশিভোর...

————————————————————




কবি প্রাকৃতজ শামিমরুমি টিটন: লেখক-সম্পাদক-প্রকাশক, জননন্দিত মহাকবি, ঔপন্যাসিক; বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি।
(উক্ত কবিতাটি তাঁর ‘অমৃত রসে মৃগতৃষ্ণা প্রেমে’ মহাকাব্য উপন্যাস থেকে সংকলিত।)