img

হার্পার কলিন্স থেকে প্রকাশ পেতে যাচ্ছে কাজী আনিস আহমেদের উপন‍্যাস ‘কার্নিভোর’

প্রকাশিত :  ১৬:৩১, ২২ জুন ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ২১:৪৮, ২২ জুন ২০২৫

হার্পার কলিন্স থেকে প্রকাশ পেতে যাচ্ছে কাজী আনিস আহমেদের উপন‍্যাস ‘কার্নিভোর’

স্বনামধন্য ব্রিটিশ-আমেরিকান প্রকাশনা সংস্থা হার্পার কলিন্স থেকে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে কাজী আনিস আহমেদের নতুন উপন‍্যাস ‘কার্নিভোর’। নিউ ইয়র্ক অভিবাসী একজন বাংলাদেশি শেফের অর্থ উপার্জনের এক ভিন্ন পথ বেছে নেওয়ার ঘটনাটি তার লেখায় উঠে এসেছে। এমন একটি পথ যেটি একটি নজিরবিহীন ঘটনাও বটে।

প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হার্পারকলিন্স জানায়, ৩২০ পৃষ্ঠার 'কার্নিভোর’ বইটি আগামী ৩০ জুন প্রকাশ হবে। বর্তমানে বইটি অ্যামাজনে অর্ডার করা যাচ্ছে। এছাড়া প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অ্যামাজন ছাড়াও যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়ার বাজারে প্রিন্ট এবং অনলাইন সংস্করণে পাওয়া যাবে। পাশাপাশি আগামী বছরের মার্চে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর আমেরিকায় বইটি প্রকাশিত হবে। এছাড়া ঢাকার বুকওয়ার্ম এবং অন্যান্য দোকানেও ইন্ডিয়ান পেপারব্যাক সংস্করণে পাওয়া যাবে , যার মুল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০০ টাকা।

বইটির আগাম প্রশংসায় ব্রিটিশ লেখক ওয়াসিম খান বলেছেন, কাজী আনিস আহমেদের লেখা তীক্ষ্ণ….যা তার আখ্যানের অন্ধকার বাঁকের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ! খাবারের বিলাসিতা ও রুচির বিকৃতির মধ‍্য দিয়ে তিনি সমাজের ক্রমবর্ধমান শ্রেনীভেদের বীভৎসতা তুলে এনেছেন।

ব্রিটিশ সাংবাদিক নিনা ভদ্রেশ্বর বলেছেন, 'কার্নিভোর একাধারে থ্রিলার, ডায়াস্পোরিক ড্রামা এবং বিলিয়নিয়ার ক্লাবের হাস্যরস সমৃদ্ধ। কাজী আনিসের নায়ক অসহায় ক্যাশ, একজন অভিবাসী বাঙালি, যে ম্যানহাটনের একটি রেস্তোরাঁ চালাচ্ছে, যা অভিনব স্বাদ তৈরি করে - কেবল সে কিছু রাশিয়ানদের কাছে লাখ লাখ টাকা ঋণী। এটা যতটা ভারত, বাংলাদেশ আর উপনিবেশের ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠI 


লেখক কাজী আনিস আহমেদ ঢাকায় বেড়ে উঠেছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। এর আগে তার একটি ছোটগল্প সংকলন, উপন‍্যাসিকা এবং একটি উপন‍্যাস প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, গার্ডিয়ান/অবজারভার, ফিনান্সিয়াল টাইমসসহ দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় লিখেছেন।

img

বাংলাদেশের ইতিহাসে রাণী ভবানী ও নাটোর রাজবাড়ী: অর্ধবঙ্গেশ্বরীর গৌরবগাথা

প্রকাশিত :  ০৯:২৫, ০৪ নভেম্বর ২০২৫

সংগ্রাম দত্ত

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত নাটোর জেলা একসময় ছিল রাজকীয় ঐশ্বর্যের কেন্দ্রস্থল। এই জেলার সদর উপজেলায় অবস্থিত বিখ্যাত রাণী ভবানী রাজবাড়ী, বাংলার ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়ের সাক্ষী। জমিদারি প্রথার উত্থান-পতনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই রাজবংশের নাম, যেখান থেকে এক নারী – রাণী ভবানী – সমগ্র বাংলার “অর্ধবঙ্গেশ্বরী” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

নাটোর রাজবংশের সূচনা: অষ্টাদশ শতকের শুরুতে নাটোর রাজবংশের যাত্রা শুরু হয়। ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে পরগণা বানগাছির জমিদার গণেশ রায় ও ভবানীচরণ চৌধুরী রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হয়ে চাকরিচ্যুত হন। তাঁদের জমিদারি কেড়ে নিয়ে দেওয়ান রঘুনন্দন তাঁর ভাই রামজীবনের নামে বন্দোবস্ত নেন। এই রামজীবনই ছিলেন নাটোর রাজবংশের প্রথম রাজা।

রাজা রামজীবন ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে) জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৭৩৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর নিজ সন্তান না থাকায় জীবদ্দশায় এক পুত্র দত্তক নেন—রামকান্ত।

রাণী ভবানীর আগমন:১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামজীবনের দত্তকপুত্র রামকান্তের সঙ্গে বিয়ে হয় রাণী ভবানীর। রাজা রামকান্তের মৃত্যুর পর ১৭৪৮ সালে নবাব আলীবর্দী খাঁ রাণী ভবানীর হাতে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন।

রাণী ভবানীর জন্ম ১৭২৩ সালে বগুড়া জেলার আদমদিঘি থানার ছাতিয়ানগ্রাম গ্রামে। তাঁর পিতা আত্মারাম চৌধুরী ও মাতা জয়দুর্গা দেবী। অল্প বয়সেই তিনি রাজবংশের বধূ হিসেবে নাটোরে আসেন।

অর্ধবঙ্গেশ্বরী রাণী ভবানী: রাণী ভবানীর রাজত্বকালে নাটোর রাজবাড়ির প্রভাব বিস্তৃত হয় এক বিশাল অঞ্চলে। তাঁর জমিদারি ছড়িয়ে ছিল বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও মালদহ পর্যন্ত।

ইংরেজ লেখক হলওয়েলের হিসাবে, তাঁর জমিদারি থেকে বার্ষিক রাজস্ব আয় হতো প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা, যা তৎকালীন সময়ের এক বিরাট অঙ্ক। দক্ষ প্রশাসন, প্রজাহিতৈষী মনোভাব ও দানশীলতার কারণে প্রজারা তাঁকে ভালোবেসে “অর্ধবঙ্গেশ্বরী” নামে অভিহিত করেছিল।

প্রজাদের কল্যাণে দানশীল রাণী: রাণী ভবানীর জীবনযাপন ছিল অনাড়ম্বর, কিন্তু সমাজসেবায় তাঁর দৃষ্টান্ত অনন্য। তিনি শত শত মন্দির, অতিথিশালা ও রাস্তা নির্মাণ করেন। প্রজাদের জন্য পুকুর খনন করে পানীয় জলের ব্যবস্থা করেন এবং শিক্ষা বিস্তারে অনুদান প্রদান করেন।

১৭৫৩ সালে তিনি কাশীতে (বর্তমান বারাণসী) ভবানীশ্বর শিব ও দুর্গাবাড়ী, দুর্গাকুণ্ড ও কুরুক্ষেত্রতলা নামক পবিত্র স্থান নির্মাণ করেন। তাঁর উদ্যোগেই হাওড়া থেকে কাশী পর্যন্ত দীর্ঘ সড়কপথ নির্মিত হয়, যা তখন পরিচিত ছিল “রাণী ভবানী রোড” বা “বেনারস রোড” নামে।

ধর্মীয় অবদান ও দেবোত্তর সম্পত্তি: বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার ভবানীপুর শক্তিপীঠ উন্নয়নে রাণী ভবানীর অবদান আজও স্মরণীয়। কথিত আছে, তিনি প্রতি বছর দু’বার হাতি বহর নিয়ে ভবানীপুরে যেতেন।

পাকিস্তান আমলে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও রাণী ভবানী স্টেটের উত্তরাধিকারীরা ২৬২ একর জমি দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে ভবানীপুর শক্তিপীঠের নামে দানপত্রে নিবন্ধন করে দেন। বর্তমানে ঐ জমির একটি বড় অংশ প্রভাবশালী মহলের দখলে চলে গেছে, যার পুনরুদ্ধারে আদালতে একাধিক মামলা চলছে।

তারাপীঠে অবদান ও বামাক্ষ্যাপার নিয়োগ: বীরভূম জেলার বিখ্যাত তারাপীঠ মন্দিরও তাঁর জমিদারির অন্তর্গত ছিল। ভগ্নপ্রায় অবস্থায় থাকা মন্দিরটি তিনি পুনর্নির্মাণ করেন এবং কিংবদন্তি সাধক বামাক্ষ্যাপাকে মন্দিরের পুরোহিত হিসেবে নিয়োগ দেন।

রাণী ভবানীর রাজবাড়ি, স্থাপত্য ও ঐতিহ্য: নাটোর রাজবাড়ি নির্মাণ শুরু হয় ১৭০৬-১৭১০ সালের মধ্যে। রাজবাড়ির আয়তন প্রায় ১২০ একর, যেখানে ছোট-বড় ৮টি ভবন, ৭টি পুকুর, এবং দুটি স্তরের বেষ্টনী প্রাচীর রয়েছে।

রাজবাড়ি বিভক্ত দুই ভাগে—বড় তরফ ও ছোট তরফ। এখানকার প্রধান মন্দিরগুলো হলো শ্যামসুন্দর মন্দির, আনন্দময়ী কালিবাড়ি ও তারকেশ্বর শিবমন্দির।

রাজবংশের রাজধানী স্থাপনের জন্য রামজীবন ভাতঝাড়ার বিল এলাকা নির্বাচন করেন, যা পরবর্তীতে “নাট্যপুর” নাম ধারণ করে “নাটোর” নামে পরিচিত হয়।

জীবনের শেষ অধ্যায়: দত্তক পুত্র রামকৃষ্ণের হাতে জমিদারি দায়িত্ব অর্পণ করে রাণী ভবানী মুর্শিদাবাদ জেলার বড়নগরে চলে আসেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ভাগীরথী নদীর তীরে তিনি নির্মাণ করেন ১০০টি শিবমন্দির, যার কিছু আজও টিকে আছে।

তাঁর মৃত্যুর পর ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁর রংপুরের জমিদারি দখল করেন। দীর্ঘ ও কর্মবহুল জীবনের পর রাণী ভবানী ১৮০২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, ৭৯ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।

বর্তমান অবস্থা: নাটোর রাজবাড়ি আজ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও পর্যটন স্থাপনা। ১৯৮৬ সাল থেকে রাজবাড়ির পুরো এলাকা জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে “রাণী ভবানী কেন্দ্রীয় উদ্যান ও যুবপার্ক” নামে পরিচালিত হচ্ছে।

রাণী ভবানী কেবল নাটোর বা রাজশাহীর ইতিহাসে নয়, সমগ্র বাংলার ইতিহাসে এক আলোকবর্তিকা—যিনি প্রমাণ করেছিলেন, নারীর নেতৃত্বও রাজনীতি ও প্রশাসনে সমান সফল হতে পারে। তাঁর স্মৃতি, দানশীলতা ও প্রজাহিতৈষী মনোভাব আজও বাংলার মাটিতে কিংবদন্তি হয়ে আছে।